অমুসলিমদের প্রতি ও সাধারন মানুষ হিসেবে সবার প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

অনেক ইসলাম বিদ্ধেষীরা বলে ইসলামে অন্য ধর্মের মানুষের উপর জুলুম করতে বলে, তাদেরকে হত্যা করতে বলে। আরো অভিযোগ ওঠে ইসলাম নাকি অমানবিক ধর্ম ও এটা নাকি মানবতার ধর্ম নয়। 


এই আর্টিক্যালে প্রমান দিব তাও রেফারেন্স সহ যে ইসলাম আসলে একজন নাগরিক হিসেবে অন্য ধর্মের মানুষদেরকে কম সুবিদা দেয়নি ও তাদেরকে পূর্ণ অধিকার, স্বাধীনতা, ও নিরাপত্তা দিয়েছে তাদের ধর্ম পালনে।  আমরা জানব অমুসলিমদের সাথে আচরণে ইসলামের নির্দেশনা ও অন্য ধর্মের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি দায়িত্ব,কর্তব্য, সুবিচার ও সম্মান সম্পর্কে ইসলাম কি বলে ইনশাআল্লাহ। 


Table of Contents

{tocify} $title={Table of Contents}

মানুষ হত্যা সম্পর্কে 

   

১) ‘যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর দায় ছাড়া কোনো মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। যে কোনো একজন মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সব মানুষের জীবন রক্ষা করল।’ [সুরা মায়িদা, আয়াত ৩২]


২) ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি কেবল এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে বা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে বা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে বা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও আখেরাতে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।’ [সুরা মায়েদা, আয়াত ৩৩]


৩) নবী ﷺ বলেছেন, ‘‘তিন অবস্থার যে কোন একটি ব্যতীত কোন মুসলমানকে হত্যা করা বৈধ নয়। প্রথমতঃ বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও যদি সে ব্যভিচার করে, তখন তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হবে, দ্বিতীয়ত ঐ ব্যক্তি, যে কোন মুসলমানকে স্বেচ্ছায় হত্যা করে তাকে হত্যা করা, তৃতীয়ত ঐ ব্যক্তি যে ইসলাম হতে বের হয়ে যায়, এবং পরে আল্লাহ্ তা‘আলা এবং আল্লাহ্‌র রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাকে হত্যা করা অন্য আরেক বর্ণনায় বলা হয়েছে মুসলিম সমাজের ঐক্য বিনষ্টকারি মুরতাদকে হত্যা করা।” [[সহিহ বুখারি ৬৮৯৯; সহিহ মুসলিম ১৬৭১, ১৮৫২; সহীহুল জামে ৭৬৪২; ইরওয়া ২১৯৬; সুনান আন-নাসায়ী ৪৭৪৩, ৪০৪৯; সূনান আবু দাউদ, হাদিস ৪৩৫২, ৪৩৫৩; বুলগুল মারাম ১১৯৭; সহীহ হাদিস]

 

৪) এগুলাত সাধারন অবস্থার কথা কিন্তু যুদ্ধরত অবস্থায়ও ইসলামের মহানুভবতা ও মানবতা কোন অংশে কম না। যেমন রাসূলুল্লাহ যুদ্ধে মহিলা এবং বাচ্চাদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। [বুখারী ৩০১৪, ৩০১৫, মুসলিম ১৭৪৪, তিরমিযী ১৫৬৯, আবূ দাউদ ২৬৬৮, ইবনু মাজাহ ২৮৪১, আহমাদ ৪৭২৫, ৬০১৯, মালেক ৯৮১; সহীহ হাদিস] 


ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত যে তিনি (ইবন আব্বাস) {এবং তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করো যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, এবং সিমালংঘন করবেনা, অবশ্যই আল্লাহ সিমালংঘনকারিদের পছন্দ করেন না }[আল-বাকারাহ : ১৯০] এর ব্যাখ্যায় বলেছেন 'তোমরা নারিদের হত্যা করবেনা, এবং হত্যা করবেনা শিশুদের, এবং বৃদ্ধদেরকেও হত্যা করবেনা, এবং এমন কাওকে হত্যা করবেনা যে তোমাদের প্রতি শান্তি-আনুগত্য পরিবেশন করে ও নিজ হাতকে যুদ্ধ হতে বিরত রাখে। যদি তোমরা এটা করো (অর্থাৎ এসব লোকদের হত্যা করো) তাহলে অবশ্যই তোমরা সিমালংঘন করেছ। [আত-তাবারী, জামিউল বায়ান ৩/২৯১; আল-ইতকান ৪/২৩৭; ত-তাফসির ওয়াল মুফাসসিরুন ১/৫৯; আস-সহিহুল মাসবুর ১/৪৬-৪৯; আয-যিয়াদাহ ওয়াল ইহসান ৯/৩৭৫; হাসান হাদীস]


যে উমার (রা) সৈন্যবাহিনীগুলোর সেনাপতিদের প্রতি চিঠিতে লিখেছেন যে 'তারা যেন আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, এবং শুধুমাত্র তাদেরকেই হত্যা করে যারা তাদের (মুজাহিদদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, এবং তারা (মুজাহিদরা) যেন নারিদের ও শিশুদের হত্যা না করে, এবং শুধুমাত্র তাদেরকেই হত্যা করে যাদের নাভির নিচে চুল গজিয়েছে ', তিনি সেনাপতিদের নিকট আরো লিখেছেন : 'যে তারা যেন যিযিয়াহ প্রয়োগ করে, এবং নারি ও শিশুদের উপর যেন জিযিয়া প্রয়োগ না করে, এবং শুধুমাত্র তাদের উপরই যিযিয়াহ প্রয়োগ করে যাদের নাভির নিচে চুল গজিয়েছে। [আল-আমওয়াল হাদিস ৯৩; ইরওয়াউল গালিল ৫/৯৬; আল-জামিউস সহিহ ৩৭/২১৬; সহীহ হাদিস]


৫) ইসলামে মুসলিম রাষ্টে সাধারনত ৪ প্রকারের কাফেরদের পাওয়া যায়। ১) জিম্মী ২) মু'আহাদ ৩) মুস্তা'মান ৪) হারবি কাফের। এই কাফেরদের হত্যা সম্পর্কে হাদিস ও আলেমদের ফতুয়া সমূহ ‍নিম্নরূপ -


জিম্মী সম্পর্কে - আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত, নবী বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম জিম্মীকে (অন্যায় ভাবে) হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধ ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ [সহীহ বুখারি, হাদিস ৩১৬৬; আবু দাউদ হাদিস ২৭৬০; মুসনাদে আহমদ ২০৬৪৮; সুনানে নাসাঈ ৪৭৪৭; আত-তা'লীকুর রাগীব ৩/২০৪; সহীহুল জামে’ ৬৪৫৬; সহীহ হাদিস উল্লেখ যে আরবিতে স্থায়ী অমুসলিম নাগরিককে আহলুয যিম্মাহ বা যিম্মী বলা হয়]

 

মুআহাদ সম্পর্কে - রাসূল বলেছেন, “সাবধান! মু'আহাদ (চুক্তিবদ্ধ) অমুসলিম নাগরিককেও চুক্তি বলবৎ থাকাকালে হত্যা করা যাবে না।” [আবু দাউদ ৪৫৩০; চুক্তি ভঙ্গ করা যাবে না কারন আল্লাহর আদেশ সূরা তাওবা আয়াত ৭]

 

মুস্তমান সম্পর্কে - আরেক বর্ণনায় এসেছে, "যে ব্যক্তি কোন লোককে নিরাপত্তা দান করার পর মুস্তা'মানকে হত্যা করলো, জাহান্নাম তার জন্য অবধারিত হয়ে গেল, যদিও নিহয় ব্যক্তি অমুসলিম হয়। [তারাবানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদিস ১৬৪৯৪; মুস্তা'মান অর্থ নিরাপত্তা আশ্রিত, বর্তমানে যে অমুসলিমরা ভিসা নিয়ে মুসলিমদের দেশে যায় তারাও মুস্তামান হিসেবে বিবেচিত হবে] 


৬) আর বাকি থাকল হারবি কাফেররা। হারবি কাফেররা হল তারা যারা জিম্মি, মুআহাদ, মুস্তামান এর আয়ওয়াভুক্ত না, সহজভাবে বলা যায় যারা লুকিয়ে বা অন্য কোন বেঠিক বা অগ্রহনযোগ্য কৌশলে মুসলিমদের দেশে প্রবেশ করেছে। হারবি কাফেরদের মধ্যে যারা যোদ্ধা নয় বা যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত নয়, তাদের হত্যা করা বৈধ নয়। নিচক কাফের বা মুশরিক হওয়ার কারনে কাউকে হত্যা করা ইসলামে জায়েজ নেই।


কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, “আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [সূরা বাকারা আয়াত ১৯০]


ওলামাগণ বলেছেন,


"শুধুমাত্র কাফের হয়ার কারনে কাওকে হত্যা করা হারাম হয়ার স্বপক্ষে প্রথম দলিল, এইযে নিতীটি আমি উল্লখ্য করলাম, তা হলো এই যে কাওকে হত্যা করা যায় তার যোদ্ধা হয়ার কারনে, তার কাফের হয়ার কারনে নয়। কোরান ও সুন্নাহ এটার দিকেই ইংগিত দেয়। এবং এই বিষয়টা গুরুত্বপুর্ন।" [কাইদাতুন মুখতাসারাহ ফি কিতালিল কুফফার পৃ. ১৮৮]


"(যুদ্ধে) মহিলাদের হত্যা করা ভালো কাজ নয়, দুইটি কারনে : একটি হলো এই যে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুদ্ধ করেনা। এবং যে যুদ্ধ করেনা তাকে হত্যা করাটা একটা অন্যায়।" [কাশফুল মুশকিল ২/৫৬৯]


যোদ্ধা কাফেরকে হত্যা করা হবে কিন্তু যে যোদ্ধা নয় তাকে হত্যা করা হবেনা [আল-মাফাতিহ ফি শারহিল মাসাবিহ ৪/৪০৮; শারহুল মাসাবিহ ৪/৩৯৭; ফাতহুল উদুদ ৩/১২২; হাশিয়াহ আলা সুনানে ইবন মাজাহ ২/১৯৫]


“ফকিহগন একমত হয়েছেন যে (ফিকহি দৃষ্টিকোনে) হারবি কাফের অর্থাৎ যে যিম্মি নয়, মুয়াহাদ নয়, মু'মিন নয় তার রক্ত(জীবন) অর্থহীন। যদি হারবি কাফের যোদ্ধা হয়ে থাকে, তাহলে তাকে কোনো মুসলিম হত্যা করলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্ত যদি সেই হারবি কাফের যোদ্ধা না হয়, যেমন : মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, অক্ষম, সন্যাসী এবং তাদের ব্যাতিত এমন সব ব্যাক্তিরা যাদের সাথে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই বা যুদ্ধের ব্যবস্থাপনায় তাদের কোনো অবদান নেই, তাহলে এইধরনের কোনো ব্যাক্তিকে হত্যা করা বৈধ নয়। কেও তাদের হত্যা করলে শাস্তি পাবে। তবে শর্ত হলো এই ব্যাক্তিরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শরিক হতে পারবেনা, পরামর্শ দেয়ার মাধ্যমে কাফের সৈন্যদের সাহায্য করতে পারবেনা, কাফের সৈন্যদের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখতে পারবেনা, কাফের সৈন্যদের উৎসাহপ্রদান করতে পারবেনা।" [আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়াতুল কুয়েতিয়াহ ৪২/১৯৮]


এই একই ফতুয়া দিয়েছেন প্রায় সব মাযহাবে আলেমরা [তাফসিরুস সা'দী পৃ. ৮৯; আল-মুগনী ১৩/১৭৫-১৮০; আত-তাজরিদ ১২/৬১৪৬; আল-ইনায়াহ ৫/৪৫৩; আল-কাফি শারহুল বাযুদী ২/৯৫৮; শারহুস সিইরিল কাবির পৃ. ৪১; আল-হিদায়াহ ২/৩৮০; আল-বিনায়াহ ৭/১০৯; ফাতহুল কাদির আলাল হিদায়াহ ৫/৪৫৩; আল-বাহরুর রাইক ৫/৮৪; ফাতহুল উদুদ ৩/১২২]


অমুসলিমদের নিরাপত্তা

 

১) হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, ‘জেনে রেখ! কোনো মুসলমান যদি অমুসলিম নাগরিকের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করে, কোনো অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোনো জিনিস বা সহায়-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়; তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমি তাদের বিপক্ষে অমুসলিমদের পক্ষে অবস্থান করব।’ [সুনানে আবু দাউদ ৩০৫২]

 

"যে ব্যক্তি কোন যিম্মীর প্রতি অবিচার করলো, তার বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন (আল্লাহর দরবারে) আমি নিজেই ফরিয়াদী হবো। [মা' আরিফুতস সাহাবাহ, (বাবুল 'আইন), হাদিস নং ৩৬০০] 

 

২) রাসূল বলেছেন, ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজরানের (সৌদি আরবের একটা জায়গার নাম যেখানে তৎকালিন খ্রিষ্টান বেশি ছিল) ভূমি এবং তার শাসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের জীবন, তাদের ভূমি, তাদের সম্পদ, তাদের উপাসনালয় সবকিছুরই নিরাপত্তা দেওয়া হবে। কোনো যাজককে তার কাজ হতে, কোন কর্মচারিকে তার চাকরি থেকে চাকরিচ্যুত করা হবে না। [কানজুল উম্মাল, ৪/৪৫৫; দালায়িলুন নুবুওয়াহ, ৫/৫৮৪]

 

মহানবী বলেছেন “তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেক, যদিও সে কাফির হয়। কেননা কোনো মাজলুমের মাঝে আর আল্লাহর মাঝে পর্দা থাকে না।” [মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১২৫৭৭]  

 

৩)  প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা) হিরা নামক স্থানের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিরাপত্তাসংক্রান্ত যে চুক্তি করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘তাদের গির্জা তথা ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করা যাবে না এবং তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া যাবে না। এবং ঘণ্টা বাজানো থেকে তাদের নিষেধ করা যাবে না। ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের সময় ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ বের করাতে বাধা দেওয়া যাবে না।’ যদি কোন অমুসলিম বৃদ্ধ অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, অথবা কোন বিপদে পতিত হয় অথবা কোন সম্পদশালী এমন ভাবে দরিদ্র হয়ে পড়ে যে, তার গোত্রের লোকেরা তাকে সাহায্য করতে থাকে এমতাবস্তায় তাকে জিযইয়া থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। উপরন্তু মুসলিমদের বাইতুল মাল থেকে তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা হবে, যতদিন সে মদীনায় বা ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করবে। [ফতোয়ায়ে হক্কানিয়া; আল-কাসানী, বাদাইউস সানাই ৭/১১৪; আবূ ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃ.১৪৪ 

 

৪) আর যদি মুশরিকদের কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায়, তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনে, অতঃপর তাকে পৌঁছিয়ে দাও তার নিরাপদ স্থানে। তা এই জন্য যে, তারা এমন এক কওম, যারা জানে না। [সূরা আত তাওবাহ আয়াত ৬]


হযরত ওমর (রা) জেরুজালেমে বসবাস রত অমুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য একটি ফরমান জারি করে [তারিখুর রাসুল ওয়াল মুলুক; তারিখে তাবারি, ২/৪৪৯]  


কোন একজন মুসলিমও যদি কোন অমুসলিমকে নিরাপত্তা দেয় তাহলে তা সব মুসলিমদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার সমান এবং সকল মুসলিমের উপর তা পালনের দায়িত্ব অর্পিত হবে অর্থাৎ সবার জন্য সেই অমুসলিমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। [সহিহ বুখারী, ৩১৭১, ১১১, ৬৭৫৫, ১৮৭০, ৩০৪৭, ৩১৭২, মুসলিম ১৩৭০, তিরমিযী ১৪১২, ২১২৭, নাসায়ী ৪৭৩৪, আবূ দাউদ ৪৫৩০, ২৭৫১, ইবনু মাজাহ ২৬৫৮, ২৬৮৫, আহমাদ ৬১৪, দারেমী ২৩৫৬, আহমাদ ৬৭৫১, ৬৯৩১, ১৬৯৭, ১৭৩১১, আবূ ইয়া’লা ৮৭৬, ৮৭৭]

 

ইসলামী রাষ্ট্রের কোন নাগরিকের জন্য মুস্তা'মানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, তাকে হত্যা করা কিংবা তার জান-মাল-ইযযাত-আব্রুর প্রতি কোন রূপ হামলা করা জায়িয নেই। [ইবনু 'আবিদীন, রাদ্দুর মুহতার, ১৬/৮১] 

 

৫) রাসুলুল্লাহ ﷺ সৈন্যদল প্রেরণকালে বলতেন, “তোমরা আল্লাহ ও আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে যাত্রা কর। তোমরা আল্লাহর প্রতি কুফরকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আমি তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিয়ে প্রেরণ করছি : (যুদ্ধক্ষেত্রে) তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, ভীরুতা দেখাবে না, (শত্রুপক্ষের) কারো চেহারা বিকৃতি ঘটাবে না, কোনো শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জা জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো বৃক্ষও উৎপাটন করবে না।” [আবদুর রাযযাক, ‘মুসান্নাফ’ ৯৪৩০]


আরো বলতেন তোমরা গির্জার অধিবাসীদেরকে হত্যা করবে না। [ইবন আবী শাইবা, ‘মুসান্নাফ’ ৩৩৮০৪]


যরত উমার ইবনু আবদিল ‘আযীয (রহ) আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দান করেছিলেন যে তারা যেন কোন উপাসনালয়, গীর্জা ও অগ্নিকুণ্ড ধ্বংস না করে।" [আল-মাওসূআতুল ফিকহিয়্যাহ, ৭/১২৯; ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা’ পৃষ্ঠা ২৫-২৮]

 

৬) উসামাহ (রা)-এর নেতৃত্বে শাম অভিমুখে অভিযান প্রেরণের সময় তার প্রতি আবু বকর (রা)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ এই ছিল যে, “তারা যেন খেয়ানত না করে, ধোকা না দেয়, শত্রুপক্ষের কারও মুখ যাতে বিকৃত না করে, কোন শিশু, নারী, বৃদ্ধকে যাতে হত্যা না করে,কোন খেজুর বাগান যাতে পুড়িয়ে না দেয়, কোন গাছ যাতে অযথা না কাটে, খাওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া কোন বকরি, উট ইত্যাদি যাতে জবাই না করে, যখন কোন সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে যাবে তখন যারা গীর্জায় উপাশনায় ব্যাস্ত তখন তাদেরকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দিবে।” [তাবারী’, তারীখুল উমাম ওয়াল মুলূক’, ২/৪৬৩; ইবনু আছীর, ‘আল-কামিল’... ১/৩৬২; খালীফাতু রাসূলিল্লাহ আবূ বাক্‌র আছ্‌ছিদ্দীক রাদিআল্লাহু ‘আনহু’ - ড. আহমদ আলী, পৃষ্ঠা ৩৫২; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৬/৩০৪]

 

আবু বকর (রা) ইয়াজিদকে উপদেশ দিয়েছিলেন: "আমি তোমাকে দশটি বিষয়ের উপদেশ দিচ্ছি: নারী বা শিশু বা বৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তিকে হত্যা করো না, ফল-ফলাদি গাছ কাটবে না, বসতি স্থাপন করো না। খাবার ছাড়া ভেড়া বা উট জবাই করো না। মৌমাছি পোড়াবেন না এবং তাদের ছিন্নভিন্ন করবেন না। লুঠ থেকে চুরি করবেন না এবং কাপুরুষ হবেন না।" [মুত্তা মালিক, বই ২১, ধারা ৩, নম্বর ১০] 

 

৭) খলিফা আবু বকর (রা) একবার তিনি জানতে পারেন, ইয়ামামার গর্ভনর মুহাজির ইবনু আবী উমাইয়্যাহ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য প্রচারণা চালানোর অভিযোগে জনৈকা অমুসলিম মহিলার হাত কর্তন করেছে এবং দাঁত উপড়ে ফেলেছেন। তখন আবু বকর (রা:) তাকে ভর্ৎসনা করে পত্র লিখেন, “আমার কাছে খবর পৌছেছে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার কারণে তুমি এক মহিলার হাত কর্তন করেছ ও দাঁত উপড়ে ফেলেছ। এ কাজ মোটেই ঠিক হয়নি। কারণ সে দলভুক্ত হলে তাকে সতর্কীকরণই যথেষ্ট ছিল। আর যিম্মীগণ তো শিরকে লিপ্ত হয়ে স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণ করছে। তবু আমরা তাদের এ রাষ্ট্রে বাস করতে দিয়েছি। এমতাবস্থায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা ভয়ানক কোন অপরাধ নয়। সর্বশেষ তিনি এটাও লিখেন যে, " তোমার এই অন্যায় যেহেতু প্রথম, তাই এবারের মতো মার্জনা করা হলো। নতুবা এর জন্য তোমাকে কঠোর সাজা ভোগ করতে হতো।” [তাবারী, তারীখুল উমাম ওয়াল মুলূক, ২/৫৫০]  

 

৮) ইমাম আবূ ইউসুফ (রাহ) 'আব্বাসীয় খলীফা হারূনুর রশীদকে অসিয়ত করেন, "অমুসলিম নাগরিকদের সাথে সদয় আচরণ করবেন, তাদের খোঁজ-খবর নেবেন, যাতে তারা কোন রূপ অন্যায়-অবিচারের সম্মুখীন না হয়, কষ্টে না পড়ে যায়, সাধ্যের বাইরে তাদের ওপর যেন কোন বোঝা চাপানো না হয় এবং অন্যায়ভাবে তাদের কোন সম্পদ যেন গ্রহণ না করা হয়। [আবূ ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃ.৭১] 

 

মুসলমানদের সরকার অমুসলিমদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা মাত্রই তাদের সাথে সংরক্ষণ চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবে এবং তাদরে জান ও মালের হিফাযত করা মুসলমানদের জন্য ফরয হয়ে যাবে। কেননা জিযিয়া গ্রহণ করা মাত্রই প্রমাণিত হয় যে, জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। (বাদায়েউস্ সানায়ে, ৭/১১১) 

 

ধর্ম পালনে স্বাধীনতা ও অধীকার


১) “আর যদি তোমার রব চাইতেন, তবে যমীনের সকলেই ঈমান আনত। তবে কি তুমি মানুষকে বাধ্য করবে, যাতে তারা মুমিন হয়?” [সূরা ইউনুস আয়াত ৯৯]


“কাজেই তুমি (নবী) তাদেরকে উপদেশ দাও, তুমি একজন উপদেশদাতা মাত্র। তুমি তাদের ওপর জবরদস্তিকারী নও।” [সূরা গাশিয়াহ আয়াত ২১-২২]


২) আল্লাহ বলেন, “দ্বিন সম্পর্কে জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে।” [সুরা বাকারা, আয়াত ২৫৬]


“আর বলে দাও, ‘সত্য এসেছে তোমাদের রবের নিকট হতে, কাজেই যার ইচ্ছে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করুক। (ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার পর)’ [সূরা কাহাফ আয়াত ২৯]

 

ইসলামে বিশ্বাসকে একজন ব্যক্তি পছন্দের উদ্বেগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এটা প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের পছন্দ এবং স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। জবরদস্তি, হুমকি বা বলপ্রয়োগের অধীনে একজন ব্যক্তির বিশ্বাস শরীয়ত দ্বারা অগ্রহণযোগ্য [জিহাত আল ইসলাম ৮/২; আল মুগনী ৮/১৪৪; ইউসুফ আলী, পবিত্র কোরআন, নোট ৫৩৪৯; তানযীম আল ইসলাম লিল মিজতামা পৃ. ১৯০] 

 

৩)  একবার মদিনার মসজিদে বসে নবী নাজরান থেকে আগত একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার বিরতিতে তারা স্বধর্ম অনুসারে প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে নবী করিম তাদের মদিনার মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন। [ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৭১]


অমুসলিমরা মুসলিম দেশে ধর্মপ্রচারের অধিকার লাভ করবে।নবিজি জীবিত থাকাকালীন ইহুদিরা মুসলিমদের কাছে ধর্মপ্রচার করতো। তবে কোনোরকম ছলনার আশ্রয় নিতে পারবে না। [সহীহ বুখারী হাদিস ৭৩৬১-৬২]

 

৪) খোলাফায়ে রাশেদীনের চিরচারিত নিয়ম ছিল, যখন কোনো সেনাবাহিনী প্রেরণ করা প্রয়োজন হতো তারা বিভিন্ন নসিহতের পাশাপাশি এ নসিহতটি অবশ্যই করতেন যে, যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধের পর বিজয়ের আনন্দে কিংবা পরাজয়ের দুঃখে ও ক্ষোভে কোনো মন্দির, গির্জা বা উপাসনালয় ভেঙে ফেলবে না। [মুসান্নাফ আবী শায়বা ৩৩৮০৪]


৫) অমুসলিমদের উপাসনালয়ের উপর হস্তক্ষেপ না করা। কেননা, নিজ নিজ ধর্ম পালন করার অধিকারও ব্যক্তিগত অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। [আহকামুয যিম্মা ফিল ইসলাম], এই মর্মে কোরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমাদের (অমুসলিম) দ্বীন তোমাদের, আর আমার (মুসলিম) দ্বীন আমার।” [কাফিরুন, আয়াত ৫]

 

ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমের জান-মাল-ইযযাত-আব্রু মুসলিমের জান-মাল ও ইযযাত-আব্রুর মতোই পবিত্র। অন্যায়ভাবে কোন অমুসলিমের জান কিংবা মাল অথবা ইযযাতের ওপর আঘাত হানা নিষিদ্ধ। [আল-মাওয়ার্দী, আল-আহকামুস সুলতানানিয়্যাহ, পৃ. ১৮৩] 

 

৬) ‘বনু আউফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই উম্মাহ। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম, তাদের মাওয়ালি বা আশ্রিত এবং তারা নিজেরাও। অবশ্য যে অন্যায় বা অপরাধ করবে সে নিজের এবং তার পরিবার-পরিজনের ক্ষতিই করবে।’ [মদিনা সনদের ২৬ অনুচ্ছেদ]


মুসলিম জনপদের অভ্যন্তরে অমুসলিমদের প্রাচীন উপাসনালয় থাকলে তার অভ্যন্তরে তারা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে। ইসলামী সরকার তাতে কোন রূপ হস্তক্ষেপ করবে না। [আল-কাসানী, ‘বাদাইউস সানাই, ৭/১১৩]

 

৭) মুসলিমরা যে সব কাজকে পাপ ও অপরাধ মনে করে, অমুসলিমরা এ ধরনের কোন কাজকে বৈধ রূপে জানলে (যেমন- মদ সেবন, শুকর পালন ও ক্রয়-বিক্রয়, ক্রুশ বহন ও শঙ্খ ধ্বনি বাজানো এবং রমযানের দিনে পানাহার প্রভৃতি) তা করতে তাদেরকে বাধা দেয়া যাবে না, যদি না তারা তা প্রকাশ্যে মুসলিমদের মধ্যে সম্পাদন করে। [আল-কাসানী, ‘বাদাইউস সানাই, ৭/১১৩]


অমুসলিমরা তাদের জনপদের মধ্যে পুরাতন উপাসনালয়গুলোর সংরক্ষণ ও সংস্কারের পাশাপাশি নতুন উপাসনালয়ও তৈরী করতে পারবে। ‘একান্ত মুসলিম জনপদে’র অভ্যন্তরে নতুনভাবে অমুসলিমদের উপাসনালয় তৈরি করতে দেয়া যাবে না। তবে সেখানে তাদের প্রাচীন উপাসনালয় থাকলে, তাতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। যদি তা ভেঙ্গে যায়, একই জায়গায় তা পুনঃনির্মাণের অধিকার তাদের রয়েছে। ‘একান্ত মুসলিম জনপদ নয়’- এ ধরনের এলাকায় অমুসলিমরা নতুন উপাসনালয় তৈরি করতে পারবে। অনুরূপভাবে যে এলাকা বর্তমানে ‘একান্ত মুসলিম জনপদ’ নয়, সরকার যেখানে জুম‘আ, ‘ঈদ ও ফৌজদারী দণ্ডবিধির প্রচলন বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানেও অমুসলিমরা নতুন উপাসনালয় তৈরি এবং প্রকাশ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে। যদি অমুসলিমদের সাথে তাদের নতুন উপাসনালয় নির্মাণে অনুমতি দেবার ব্যাপারে চুক্তি হয়, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র তাদেরকে এর অনুমতি দিতে বাধ্য থাকে। [আল-কাসানী, ‘বাদাই’, ৭/১১৪; বাদা’উস সানাই’ ৭/১১৪; আল খুরাশী ৩/১৪৮; মাওদূদী, ‘ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান’, পৃ. ৩৯৫; কানযুদ্ দাকায়িক’ (‘তাসহীলুল হাকায়িক’ শরাহ) – মূলঃ ইমাম নাসাফী, ২/৪৬২; আশরাফুল হিদায়া, ৪/৪৯৩-৯৪]

 

৮) খলিফা আবু বকর (রা) এর শাসন আমলে ইরাকের হীরাবাসীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্রে বলা ছিল, “তাদের খানকাহ ও গির্জাগুলো ধ্বংস করা হবে না। প্রয়োজনের সময় শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য যে সব ইমারতে তারা আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে সেগুলোও নষ্ট করা হবে না। নাকুস ও ঘণ্টা বাজাতে নিষেধ করা হবে না। আর উৎসবের সময় ক্রুশ মিছিল বের করার ওপরও কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে না।” [কিতাবুল খাৱাজ’ – ইমাম আবু ইউসুফ, ১/১৭০; ই’লাউস সুনান’ – জাফর আহমাদ উসমানী ১২/৫২২]

 

৯) উমাইয়্যাহ শাসক ওয়ালীদ ইবন আবদিল মালিক দামেস্কের ইউহান্না গীর্জা জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। হযরত উমর ইবন আবদিল আযীয (রহ:) ক্ষমতায় এলে খ্রিস্টানরা এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়েল করে। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে লিখে পাঠালেন, মসজিদেত যেটুকু অংশ গীর্জার জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে, তা ভেঙে খ্রিস্টানদের হাতে সোর্পদ করে দাও। [আল-বালযূরী, ফুতুহুল বুলদান, ৯/২১৩] 


অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক ও অমুসলিমদের অধিকার


১) মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্‌র কোন সম্পর্কে থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন। [সূরা আলে ইমরান আয়াত ২৮]


আল্লাহ বলেন, ‘দ্বিনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি তাদের সঙ্গে মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। আল্লাহ শুধু তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করাতে সাহায্য করেছে। আর তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারাই তো যালিম।’ [সুরা মুমতাহিনা, আয়াত ৮,৯]

 

এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে “অন্য কথায়, আল্লাহ আপনাকে সদয় হতে, বন্ধন বজায় রাখতে, অনুগ্রহ ফিরিয়ে দিতে এবং মুশরিকদের (মুশরিকদের) প্রতি ন্যায্য আচরণ করতে নিষেধ করেন না, তারা আত্মীয় হোক বা অন্যরা হোক, যতক্ষণ না তারা আপনার ধর্মের কারণে বা অন্য কারণে আপনার সাথে যুদ্ধ করছে না, তোমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে না। সুতরাং তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে আপনার কোন ভুল নেই, কারণ এই ক্ষেত্রে তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা এমন কিছু জড়িত নয় যা নেতিবাচক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।" [তাফসির আল-সা'দী, পৃ. ৮৫৬]

 

আল্লাহ যেমন কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন ঠিক তেমনই আবার এটাও বলে দিয়েছেন কোন কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছে।


২) আল্লাহ বলেন, ‘তোমার মাতা-পিতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মানবে না, তবে পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে বসবাস করবে সদ্ভাবে।’ [সুরা লোকমান, আয়াত ১৫]

 

৩) আর ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন তা দ্বারা যা উৎকৃষ্ট; ফলে আপনার ও যার মধ্যে শক্ৰতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। [সূরা হামিম সেজদা আয়াত ৩৪] 


“ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ তা‘আলা এদেরকেই করেন অভিশপ্ত, বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন”। [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত ২২-২৩]

 

৪) অতঃপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য আমরা তাদেরকে লা'নত করেছি ও তাদের হৃদয় কঠিন করেছি; তারা শব্দগুলোকে আপন স্থান থেকে বিকৃত করে এবং তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তার একাংশ তারা ভুলে গেছে। আর আপনি সবসময় তাদের অল্প সংখ্যক ছাড়া সকলকেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে দেখতে পাবেন, কাজেই তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং উপেক্ষা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মুহসিনদের ভালবাসেন। [সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ১৩]

 

৫) আসমা বিনতে আবূ বকর (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার মা, যিনি মুশরিক ছিলেন, তাঁর পিতার সঙ্গে আমার নিকট এলেন, যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কুরাইশরা চুক্তি করেছিল। তখন আসমা (রা) আল্লাহর রাসূল -কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা আমার কাছে এসেছেন (আমার সম্পদের লোভ রেখে), তিনি ইসলামের প্রতি আসক্ত নন। আমি কি তাঁর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব?’ আল্লাহর রাসূল বললেন, ‘হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর।’ [বুখারী ২৬২০, ৩১৮৩, ৫৯৭৯; মুসলিম ২৩৭১-২৩৭২; হাদিস সম্ভার ১৭১৬]


ইবনু ’উমার (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা ’উমার (রা) এক জোড়া রেশমী ডোরাদার কাপড় বিক্রি হতে দেখেন। এরপর তিনি (নবী -কে) বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এটি ক্রয় করুন, জুমু’আর দিনে, আর আপনার কাছে যখন প্রতিনিধি দল আসে তখন আপনি তা পরবেন। তিনি বললেনঃ এটা সে-ই পরতে পারে, যার জন্য কল্যাণের কোন হিস্যা নেই। এরপর নবী এর নিকট এ জাতীয় কারুকার্য খচিত কিছু কাপড় আসে। তিনি তা থেকে এক জোড়া কাপড় (হুল্লা) ’উমার (রা)-এর নিকট পাঠিয়ে দেন। তিনি (এসে) বললেনঃ আমি কীভাবে এটি পরবো? অথচ এ সম্পর্কে আপনি যা বলার তা বলেছেন। নবী বললেনঃ আমি তোমাকে এটি পরার জন্য দেইনি, বরং এ জন্যেই দিয়েছি যে, তুমি ওটা বিক্রি করে দেবে অথবা অন্যকে পরতে দেবে। তখন ’উমার (রা) তা মক্কায় তার ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেন, যে তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। [সহিহ বুখারি ৫৯৮১] 


৬) রাসুলুল্লাহ বলেছেন, ‘অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা করা আমার উপর আরোপিত বিশেষ কর্তব্যগুলোর একটি।’ [সুনানে বায়হাকী, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ৩০]


ইসলামী আইনতত্ত্ববিদগণের ভাষায় - "মুসলিমদের জন্য (রাষ্ট্রে) যে রূপ অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তাদের জন্যও ঠিক একই রূপ অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থাকবে। উপরন্তু, মুসলিমরা যে রূপ শাস্তি ও দণ্ডের সম্মুখীন হবে, তারাও অনুরূপ শাস্তি ও দণ্ডের সম্মুখীন হবে। [আল-কাসানী, বাদা'ই ৭/২৮৮; আন-নাবাবী, আল-মাজমূ' শারহুল মুহাযযাব, ১১/৩০৬]


“সংরক্ষিত নাগরিক” (যিম্মি) পরিণত হয়ে পাওয়ার পর তাদের জমির মালিক তারাই হবে। সেই জমির মালিকানা উত্তরাধিাকার সূত্রে হস্তান্তরিত হবে এবং তারা নিজেদের সম্পত্তি বেচা, কেনা, দান করা ও বন্ধক রাখা ইত্যাদির নিরংকুশ অধিকারী হবে। ইসলামী সরকার তাদেরকে বেদখল করতে পারবেনা। [ফাতুহুল কাদীর ৪/৩৫৯]

 

একজন অমুসলিম একদিন খলীফা উমার ইবন 'আবদীল আজীয (রহ)-এর দরবারে আপীল করে যে, 'আব্বাস ইবনু ওয়ালীদ অন্যায়ভাবে তার ভূমি দখল করে রেখেছে। খলীফা আব্বাসকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন: "এ অমুসলিম ব্যক্তি দাবীর ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কী? আব্বাস জবাব দিলো, " আমার পিতা ওয়ালীদ এ ভূমি আমার জায়গাদারীতে অর্পণ করেছেন। " এ কথা শুনে অমুসলিম ব্যক্তিটি বলল, "আমীরুল মুমিনীন! আপনি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করুন।" খলীফা বললেন, "আব্বাস! আল্লাহ কিতাব অমুসলিমদের ভূমি জবর দখল করে তাতে কাউকে জায়গাদারী দেয়া যায় না।" আব্বাস বললো, "আপনার কথা সত্য; কিন্তু আমার নিকট খলীফা ওয়ালীদের প্রমাণপত্র রয়েছে। আপনার পূর্বের একজন খলীফার ফরমান রদ করার অধিকার কী আপনার আছে? খলীফা জবাব দিলেন, " ওয়ালীদের প্রমাণপত্রের চাইতে আল্লাহর কিতাব অনেক ঊর্ধ্বে। এ ভূমি এ অমুসলিমকে ফেরত দাও।" [ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৯/২১৩] 

 

ইসলামিক পন্ডিতরা একমত যে কোন মুসলিম রাষ্ট্রে কোন অমুসলিমকে জোড় করা হবে না ইসলাম গ্রহনে। ইসলামিক রাষ্ট্রের অধিনে মুসলিম ও অমুসলিম সবাই নিরাপত্তার সাথে যার যার দীন পালন করবে স্বাধীন ভাবে। [হুকুক আল-ইনসান বাইন আল-শরিয়াহ আল-ইসলামিয়া ওয়াল-ফিকর আল-কানুনি আল-গারবি পৃ. ৯১; রুহ আল-মাআনি ফী তাফসীরি-ল-কুরআনি-ল-আঈম ৫/১৪৪] 

 

৭) ‘ইসলামী আইন শাস্ত্রে বলা আছে শিশু-কিশোর, নারী, পাগল, দাস-দাসী, প্রতিবন্ধী, উপাসনালয়ের সেবক, সন্যাসী, ভিক্ষু, অতি বয়োবৃদ্ধ এবং বছরের বেশির ভাগ সময়ে রোগে কেটে যায় এমন লোকদের জিজিয়া দিতে হবে না। শুধু তাই নয়, ইসলামী রাষ্ট্রের রাজকোষ ‘বায়তুল মাল’ থেকে রাষ্ট্রের গরিব, দুঃস্থ, অসহায়  অমুসলিমদের অর্থ প্রদান করে সহায়তারও বিধান রয়েছে ইসলামী আইনে’। [কিতাব আল খারাজ, পৃষ্ঠা ১৪৪ ও ১৫৫; আল মুগনী’, ৯/২৭০-২৭৩; বাদা’ই, আল কাসানী, ৭/১১১] 

 

৮) অমুসলিম পুরুষরা দেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলে তাদের জিজিয়া মওকুফ হতে পারে [‘সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ’ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ‘জিযয়া’ অংশ, পৃষ্ঠা ৪০১; আহকামুয যিম্মিয়িন ওয়াল মুসতা’মিমীন ফি দারি ইসলাম’, পৃষ্ঠা ১৫৭]


শুধু তাই নয়,নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে মুসলিম রাষ্ট্র পুনরায় জিজিয়া কর ফেরত দিয়ে দেবে অমুসলিমদের [কিতাবুল খারাজ’, পৃষ্ঠা ১১১]

 

৯) হযরত উমর (রা)-এর ঘটনা। তিনি তখন খলীফাতুল মুসলিমীন। একদিন এক ইহুদি বৃদ্ধকে দেখলেন মসজিদের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে বেড়াতে। তখন তিনি ইহুদিকে লক্ষ করে বললেন, আমরা তোমার ওপর ইনসাফ করতে পারিনি যদি তোমার যৌবনে আমরা তোমার নিকট থেকে জিয্য়া গ্রহণ করে থাকি আর তোমার বার্ধক্যে তোমাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেই। এরপর তিনি তার জন্যে বায়তুল মাল থেকে প্রয়োজনীয় ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। এমনই আরো ৩/৪টা ঘটনা আছে যেখানে ওমর (রা) অমুসমিল দরিদ্র বা অসহায় ব্যাক্তিদেরকে সাহায্য করেছেন ও জিজিয়া কর থেকে মুক্ত করেছিলেন। [কিতাবুল আমওয়াল, ইবনে যানজূয়াহ্, ১/১৪৩, হাদীস ১৭৯; ‘ফুতুহুল বুলদান’ -আল বালাযুরী, ১/১৭৭; ‘বিশ্বশান্তি ও ইসলাম’ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) - সাইয়িদ কুতুব শহীদ, পৃষ্ঠা ১৭৭-১৭৮]

 

যে সব অমুসলিম নাগরিক দ্রারিদের শিকার ও পরের ওপর নির্ভর করে, তাদের জিযইয়া তো মাফ হবেই, উপরন্তু তারা তাদের জন্য বাইতুল মাল থেকে নিয়মিত সাহায্যও বরাদ্দ দেয়া হবে। [ইবনু কুদামাহ, আল-মাগনী, ৯/২৭২] 

 

১০) আলি (রা) বলেছিলেন জিজিয়া কর নেওয়ার সময় কাউকে চাবুক মারা যাবে না, ১ পায়ে দাড় করিয়ে রাখা যাবে না, তাদের প্রয়োজনিয় পশু বিক্রি করা যাবে না, তাদের কাপড় ও ঘরের সামগ্রি বিক্রি করা যাবে না। [‘কিতাবুল খারাজ’ – ইমাম আবু ইউসুফ(র.), পৃষ্ঠা ১৫-১৬]


অধিকাংশ ইমামের মতে, জিজিয়ার কোনো বিশেষ পরিমাণ নির্ধারিত নেই [‘খলিফাতু রাসূলিল্লাহ আবু বাকর আছছিদ্দীক (রা)’ পৃষ্ঠা ৩৫৭] 


ইমাম শাফেই (রহ) একটি হাদিসের উপর ভিত্তি করে মত দিয়েছেন যে জিজিয়া করের পরিমান হচ্ছে ১ দিনহার অর্থাৎ অমুসলিম ধনী-গরিব সবার কাছ থেকে শুধু একদিনহার পরিমান কর নেওয়া হবে জিজিয়া হিসেবে [আশরাফুল হিদায়া ৪/৪৭৮] 


অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি 

 

১) আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানবজাতিকে সম্মানিত করেছি, তাকে কর্তৃত্ব দিয়েছি স্থলে ও জলে, তাদেরকে দিয়েছি উত্তম জীবিকা এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি আমার সৃষ্টিজগতের অনেকের ওপর।’ [সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৭০]

 

২) আনাস ইবনু মালিক (রা) হতে বর্ণিত। একদা এক বেদুঈন মসজিদে প্রস্রাব করলো। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। আল্লাহর রসূল বললেনঃ তার প্রস্রাব করা বন্ধ করো না। অতঃপর তিনি এক বালতি পানি আনালেন এবং পানি প্রস্রাবের উপর ঢেলে দেয়া হলো।’ [সহীহ বুখারী ৬০২৫; সহীহ মুসলিম ২৮৪]

  

৩) 'আর আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমলংঘন করে অজ্ঞানতাবশতঃ আল্লাহকেও গালি দেবে' [সূরা আল আন‘আম, আয়াত ১০৮]


"(মুহাম্মদ ) বলুন,বিশ্বাসীদেরকে, তারা যেন তাদের ক্ষমা করেন যারা আল্লাহ দিবসগুলোকে বিশ্বাস করে না ;যাতে আল্লাহ-ই মানুষকে তাদের ভালো ও খারাপের জন্য প্রতিদান দিতে পারেন।" [সূরা জ্বাছিয়াহ আয়াত ১৪]

 

৪) সাহাবী হযরত জাবের (রা) বর্ণনা করেন, একদিন আমাদের পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তা দেখে রাসূলুল্লাহ দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর দেখাদেখি আমরাও দাঁড়ালাম। আমরা তাঁকে বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ তো এক ইহুদির লাশ!’ রাসূলুল্লাহ বললেন, ‘যখন কোনো লাশ নিতে দেখবে, তখন দাঁড়াবে।’ [সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩১১]


আরেক হাদীসে এসেছে, হযরত সাহল ইবনে হুনাইফ ও হযরত কায়েস ইবনে সাদ (রা) একদিন বসা ছিলেন। তারা তখন কাদিসিয়ায় থাকেন। পাশ দিয়ে একটি লাশ নেয়া হচ্ছিল। তা দেখে তারা দুজনই দাঁড়ালেন। উপস্থিত লোকেরা তাদেরকে জানাল, ‘এ এক অমুসলিমের লাশ।’ তাঁরা তখন শোনালেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পাশ দিয়েও একবার এক লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি যখন তা দেখে দাঁড়ালেন, উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম তখন বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। রাসূলুল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে মানুষ ছিল তো?’ [সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩১২]

 

৫) রাসুল এবং তার সঙ্গীরা যখন মক্কা বিজয় করে আবার স্বদেশে ফিরে আসেন তখন মুসলিমদের এক সেনাপতি বজ্রকণ্ঠে ঘােষণা করে বসেন। ‘আজ হচ্ছে আমাদের প্রতিশােধ নেবার দিন। তার মুখে এই কথা শুনে রাসূল তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘না! আজ হচ্ছে উন্মুক্ত ক্ষমার দিন। এরপরে, রাসূল মক্কার মুশরিকদের দিকে ফিরে বললেন, আজ তােমরা আমার কাছ থেকে কেমন আচরণ আশা করাে?’ মুশরিকরা বলল, আমরা আপনার কাছ থেকে তেমন আচরণই আশা করি, যেমন আচরণ ইউসুফ (আ) তার পাপিষ্ঠ ভাইদের সাথে করেছিলেন। তখন রাসূল ঠিক সেই কথাটাই বললেন যা ইউসুফ (আ) তার ভাইদের সাথে বলেছিলেন- আজ তােমাদের আর কোনাে প্রশ্ন করা হবে না। আজ তােমরা সকলেই মুক্ত। [ফাতহুল বারী,ইমাম ইবনু হাজার আসক্বালানী, খ. ৮, পৃ. ১৮]

 

৬) একবার তাঈ গোত্রের লোকেরা মহানবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এতে তাদের কিছু সংখ্যক লোক বন্দী হয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে আরবের প্রসিদ্ধ দাতা হাতেমের এক মেয়েও ছিল। যখন সে মহানবীর কাছে বললো, সে হাতেম-তাঈর মেয়ে, এ কথা শুনে মহানবী তার সঙ্গে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করলেন এবং তার সুপারিশক্রমে তার গোত্রের শাস্তি ক্ষমা করে দিলেন’ [সীরাত হালবিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ-২২৭]


৭) তাদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। এবং বলে, শুধু আল্লাহর সস্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে খাবার দান করি, আমরা তোমাদের কাছ থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়। [সূরা আল ইনসান আয়াত ৮,৯]


এই আয়াতের আলোকে অমুসলিমদেরকেও দান করতে বলা হয়েছে, বিস্তারিত তাফসিরে দেখতে পারেন [ আয়াত ৮ , আয়াত ৯ ] ইবনু কুদামা বলেন, তখন (এই আয়াত যখন নাজিল হয়েছিল) কেবল কাফেররাই মুসলমানদের হাতে বন্দী ছিল [ ইবনু কুদামা, মুগনী ২/৪৯২]


নিশ্চয় সদাকা হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। [সূরা তাওবা আয়াত ৬০, এই আয়াতের তাফসিরে বিস্তারিত বলা হয়েছে যে কাফেরকেও সদকা করা যাবে আ ৬০]


একটি বর্ণিত পাওয়া যায় একজন ইহুদী মহিলা আয়েশা (রা)-এর কাছে ভিক্ষা করতে আসলেন, ‘আয়িশাহ্ (রা) তাকে কিছু দিলেন তখস নারীটি আয়শা (রা) কে বলল, আল্লাহ্ তা‘আলাও আপনাকে কবর আযাব হতে রক্ষা করুন। অতঃপর ‘আয়িশাহ্ (রা) আল্লাহর রাসূল -কে জিজ্ঞেস করেন, কবরে কি মানুষকে আযাব দেয়া হবে? আল্লাহর রাসূল বললেনঃ এত্থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। [বুখারী ১০৪৯, ১০৫৫, ১৩৭২, ৬৩৬৬; মুসনাদে আহমদ, ২৪৮১৫, ২৫৪১৯]

 

ফতোয়ায়ে শামি থেকে নবীজীর একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, মক্কার কাফেরদের সঙ্গে যখন চরম দুশমনি চলছে মদীনার। ঠিক সে সময়ে মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রাসুল সা ও সাহাবিরা নিজেরাই তখন কষ্টে আছেন তা সত্ত্বেও মদীনা থেকে ৫০০ স্বর্ণমুদ্রা পাঠিয়ে দেন মক্কার কাফের সর্দার আবু সুফিয়ান ও সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার নিকট। মক্কার দরিদ্র মানুষদের মাঝে বণ্টন করে দিতে বলেন। [ফাতাওয়ায়ে শামি ৩/৩০২] 


অমুসলিমরা যাকাতের হকদার নয়। তবে কিছু আলেমদের মতে যদি সর্বোচ্চ ধারণা হয় যে, আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের অন্তর ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে বা অন্তত মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইসলামের বিরুদ্ধে কোন কাজ করবে না সেক্ষেত্রে ‘মুআল্লাফাতুল কুলূব’ খাত থেকে তাদেরকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যেতে পারে [ইবুন কুদামা, মুগনী মাসআলা ক্রমিক ৫১০৬, ৬/৪৭৫; শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন, ফাতাওয়া ইসলামিয়াহ ৮/৪০৩]


অভাবগ্রস্ত, দরিদ্র, মিসকিন, গরিব অমুসলিমকে (ফাসেক, ইহূদী, নাছারা, মূর্তিপূজক, কাফের, মুশরিক) নফল সদকা দেওয়া অনুমোদিত, এবং এই দানকারীকে পুরস্কৃত করা হবে আখিরাতে ইনশাআল্লাহ। [মুগনি আল-মুহতাজ ২/৫১০; আল-বাহর আল-রাঈক শারহ কিঞ্জ দাকাইক ৫/২০৪; আল-শারহ আল-কাবিরের দুসুকির ভাষ্য ৪/১২২; শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন, ফাতাওয়া ইসলামিয়াহ ৮/৪০৩; কিতাব আল-উম, খন্ড ২; নববী, আল-মাজমূ‘ ৬/২৪০; তাবয়িনুল হাকায়েক, ১/৩০০; রাদ্দ আল-মুহতার ১০/৩৪৬, ২/৩৬৯; আদ দুরুল মুখতার, ৩/৩৫৩; ফতোয়ায়ে দারুল উলুম, ৬/২২০; কিফায়াতুল মুফতি, ৪/২৭৯; বাদায়েউস সানায়ে ২/১৬১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৮৮; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/২১১]


বিচার ব্যবস্থা এবং মানুষের প্রতি মানুষের আচরন যেমন হবে


১) আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইহুদি নবী এর খেদমত করত। সে অসুস্থ হলে নবী তাকে দেখতে গেলেন। তার মাথার দিকে বসে নবীজি বলেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। তখন সে তার পিতার দিকে তাকাল। পিতা বলেন, তুমি আবুল কাসেমের (নবীর) অনুসরণ করো। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করল। তখন নবী এই বলে বের হলেন, ‘আল্লাহর শুকরিয়া, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’ [বুখারি, হাদিস ১২৯০]


আরেক হাদিসে নবী বলেছেন, “যার অন্তরে অণুপরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অহংকার হচ্ছে দম্ভভরে সত্য ও ন্যায় অস্বীকার করা এবং মানুষকে ঘৃণা করা।” [সহিহ মুসলিম ১৬৬]


২) অসুস্থ ব্যাক্তির সেবা করা মানে আল্লাহর সেবা করা সেবা, ক্ষুদার্থকে খাবার খাওয়ানো মানে আল্লাহকে খাবার খাওয়ানো [সহীহ মুসলিম ২৫৬৯]


রাসূল বলেছেন, যে (সৃষ্টির প্রতি) দয়া করে না, (আল্লাহর পক্ষ থেকে) তার প্রতি দয়া করা হয় না। [বুখারি ৬০১৩; সহিহ মুসলিম ২৩১৯],আরেক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ আল্লাহ্ তার প্রতি রহম করেন না, যে মানুষের প্রতি রহম করে না। [বুখারি ৭৩৭৬]


আল্লাহর শপথ, আল্লাহ আপনাকে (নবী কে) কখনো অপমানিত করবেন না। কারণ, আপনি আত্মীয়দের প্রতি দয়াশীল, পীড়িত মা ও আতুরদের ব্যয়ভার বহন করেন, নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করেন, আপনি অতিথিপরায়ন এবং সত্যিকার বিপদাপদে সদা সাহায্যকারী।’ [বুখারী ০৩; মুসলিম ৪২২]


যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’ [আল-মুজামুল আওসাত: ৫৭৮৭]


এছাড়া কৃপনতা না করে দান করা, ‍ঋণ দেওয়া, বিপদে ও ভালো কাজে মানুষকে সাহায্য করা, অভাবগ্রস্তদেরকে সাহায্য করা, রোগীর সেবা করা, মানুষের সাথে ভালো আচরন করা, ক্ষুদার্থকে খাদ্য দান ইত্যাদি নিয়ে আরো দেখতে পারেন - [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত ১১, সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৮৩, ১৭৭, ২১৫, ২৬১, সূরা আল-হাদীদ, আয়াত ১৮, সূরা বালাদ ১৪-১৬, সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত ১৬-১৭, সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত ২০, সূরা আল-মা‘আরিজ, আয়াত ২৪-২৫, সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ১৯, সুরা মায়েদা, আয়াত ২, সূরা হামিম সেজদা আয়াত ৩৪, সূরা আল-মুমিনুন আয়াত ৯৬, সূরা আনফাল আয়াত ৪১, মুসলিম ২২৬, ২৬৭১, ৫৭৭৮, ৬৭৪৬, ৭০২৮, ৬৭২১, ৭৬৫৯, ১৫৬৩, ২৬৯৯, বুখারী ৬২৩৬, ৬০০৭, ৩৩৩১, ২৫৬৬, ২৪৪২, ৫৬৪৯ আবূ দাঊদ ৪৯৪৮, ৪৮৯৩, ৪৯৪৬, ১৪০০ তিরমিযী ১৪২৫, ২৭৩৭, ১৩০৬, ১৪২৫, ১৯৫৬, সহীহ ইবন হিব্বান ৭৩৬, ৩৩২৪, মুসনাদ আবী ই‘আলা ৭৩২৫, মুসনাদ আহমাদ ৮৮৩২, ৬৭৬৫, ১৯৫১, ২৯১১, মিশকাত, পৃ. ১৬৭, ৪৯৯১, ৪৬৩০, ১৫২৩, ২০৪, ৪৯৪৭, নাসাঈ ৪২১০, ২৫৭৬, ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৫৭৫, আত-তারগীব ১৭৭৬, ২৫৮৬, ২৫৬১, ৮৯৯, ৯০৯ বায়হাক্বী ২০১৬০, তাবারানী ১/১৪৩, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৪০৭, ইবনু মাজাহ হা/২৪১৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৫৭৭, ১৬২৪, ৬৫৭৭, ৩৫২২, আল-মুজামুল কাবীর ১৩৫০৮]


৩) ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর। এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত’। [সূরা আল-মায়িদা আয়াত ৮]


৪) “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর জন্য দৃঢ়ভাবে দাঁড়াও এবং ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী হও এবং অন্যের শত্রুতা ও বিদ্বেষ যেন তোমাকে ন্যায়বিচার এড়াতে বাধ্য না করে। ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করঃ এটাই তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত” [সূরা মায়িদাহ আয়াত ৮]

 

আর কেউ কোন দোষ বা পাপ করে পরে সেটা কোন নির্দোষ ব্যক্তির প্রতি আরোপ করলে সে তো মিথ্যা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে। [সুরা নিসা আয়াত ১১২]


হে দাউদ! আমরা আপনাকে যমীনে খলীফা বানিয়েছি, অতএব আপনি লোকদের মধ্যে সুবিচার করুন এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না, কেননা এটা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। [সূরা সোয়াদ আয়াত ২৬]

 

অবশ্যই আমরা আমাদের রাসূলগনকে পাঠিয়েছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়ের পাল্লা, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। [সূরা আল হাদীদ, আয়াত ২৫] 


৫) একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। [সহিহ মুসলিম, তিরমিজি, সুনান আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, সুনান ইবনে মাজাহ - বিদায় হজের ভাষন]


৬) রাসূলুল্লাহ বলেছেন, ‘‘যে পছন্দ করে যে, তাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হোক এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হোক, তার মরণ যেন এমন অবস্থায় হয় যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান রাখে এবং অন্যের প্রতি এমন ব্যবহার দেখায়, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।’’ .. হাদীসের অংশ বিশেষ [মুসলিম ১৮৪৪, নাসায়ী ৪১৯১, আবূ দাউদ ৪২৪৮, ইবনু মাজাহ ৩৯৫৬, আহমাদ ৬৪৬৫]


ইসলামে বার বার ক্ষমা করার আদেশ ও উপদেশ দেওয়া হয়েছে [সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৪, সুরা শুরা, আয়াত ৪০, সূরা আল-আ’রাফ ১৯৯, সূরা জাছিয়া আয়াত ১৪ মুসলিম, হাদিস ২৫৮৮, বুখারি, হাদিস ৩০৩৮, মুসনাদে আহমাদ হাদীস ১৭৪৫২]


৭) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিতঃ যে ব্যক্তি তার কওমের লোকদেরকে অন্যায়ভাবে সাহায্য করে, সে ঐ উটের মত, যেটিকে গর্তে পড়ার পর তার লেজ ধরে টানা হচ্ছে। [সুনানে আবু দাউদ - ৫১১৫]


আমি রাসুল ﷺ কে বলতে শুনেছি, “মানুষকে শাস্তি দিয়ো না। পৃথিবীতে মানুষকে যারা (অন্যায়ভাবে) শাস্তি দেবে, আখিরাতে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন।” [তাফসির মাযহারী – কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী (র), ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০৬; সুনান আবু দাউদ, হাদিস ৩০৩৪]

 

৮) "কোনো ব্যাক্তির অপরাধকে ব্যাক্তিগত অপরাধ হিসেবে গন্য করা হবে। ব্যাক্তির অপরাধের জন্য ঘোটা সম্প্রদায়কে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না" [হযরত মুহাম্মদ (মদিনা সনদ)] 


আরেক বর্ণনায় এসেছে রাসূল ﷺ বলেছেন, “সাবধান! অপরাধী তার অপরাধের জন্য নিজেই দায়ী। সাবধান! সন্তানের প্রতি জনকের অপরাধ এবং জনকের প্রতি সন্তানের অপরাধ বর্তায় না।” [সহীহ ইবনু মা-জাহ ৩০৫৫; সুনানে তিরমিজি ২১৫৯]

 

আল্লাহ বলেছেন, “প্রত্যেকে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেউ অন্য কারো ভার গ্রহণ করবে না।” [সুরা আনআম আয়াত ১৬৪]

 

৯) মুআয ইবনে জাবাল (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ কে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, একজন প্রতিবেশীর ওপর আরেকজন প্রতিবেশীর কী হক রয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘যদি সে তোমার কাছে ঋণ চায় তাহলে ঋণ দেবে, যদি তোমার সহযোগিতা চায় তাহলে তাকে সহযোগিতা করবে, যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তার খোঁজখবর নেবে, তার কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে তাকে তা দেবে, সে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার খোঁজখবর নেবে, যখন সে ভালো কিছু লাভ করবে তখন তাকে শুভেচ্ছা জানাবে, যদি সে বিপদে পড়ে তাহলে সান্ত্বনা দেবে, মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায়  শরিক হবে, তার অনুমতি ছাড়া তোমার ঘর এত উঁচু করবে না যে তার ঘরে বাতাস ঢুকতে পারে না, কোনো ভালো খাবার রান্না করলে তাকে এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে কষ্ট দেবে না, তবে যদি তার ঘরেও সে খাবার থেকে কিছু পৌঁছে দাও। যখন কোনো ফল কিনে তোমার বাড়িতে নেবে তখন হাদিয়াস্বরূপ তাকে সেখান থেকে কিছু দেবে। [খারায়েতী, তবারানী, আবুশ শায়খ- ফাতহুল বারী, ১০/৫১৯; কিতাবুল আদব, বাব-৩১]

 

আরেক হাদিসে এসেছে, মহানবী বলেছেন, “সে প্রকৃত মুমিন নয় যা পেট পূর্ণ থাকে অথচ তার প্রতিবেশি ক্ষুধার্ত” [আল সুনান আল কুবরা ১৯০৪৯] অনেকটা একই বর্ণনা রয়েছে অন্য এক হাদিসে যেখানে ইবনে আব্বাস (রা) ইবনুয যুবাইর (রা)-কে অবহিত করে বলেন, আমি নবী -কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে তৃপ্তি সহকারে আহার করে সে মুমিন নয়। [আদাবুল মুফরাদ, হাদিস ১১১]

 

আমর ইবনে মুআয আল-আশহালী (র) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ আমাকে বলেছেনঃ হে মুমিন নারীগণ! তোমাদের মধ্যকার কোন নারী যেন তার প্রতিবেশীকে যৎসামান্য দান করাকেও তুচ্ছ মনে না করে, যদিও তা রান্না করা বকরীর বাহুর সামান্য গোশতও হয়। [ আদাবুল মুফরাদ, হাদিস ১২১] 

 

১০) রাসুলুল্লাহ তার প্রিয় সাহাবি হজরত আবু যর (রা) লক্ষ্য করে বলেছেন- হে আবু যর! যখন তুমি (ঝোল তরকারি) রান্না করবে, তখন তাতে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দাও এবং তোমার প্রতিবেশীর প্রতি খেয়াল রাখ।’ [মুসলিম] ও প্রতিবেশীর দাওয়াতে অংশগ্রহণ করলে সাধ্যানুযায়ী উপহার-উপঢৌকন দেয়া। [মুসলিম] ও  প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত হলে তার সঙ্গে খাবার ভাগ করে নেয়া। [মুসলিম], ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেন, ‘জিবরাঈল (আ) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অবিরত উপদেশ দিচ্ছিলেন, এমনকি আমি ধারণা করলাম যে, আল্লাহ তাদের ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন।’ [বুখারি, হাদিস ৫৬৬৮; মুসলিম, হাদিস ৬৮৫৪]


মুজাহিদ (রহঃ) হতে বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-এর জন্য তার পরিবারে একটি ছাগল যবেহ করা হল। তিনি এসে বললেন, তোমরা কি আমাদের ইয়াহুদী প্রতিবেশীকে (মাংস) উপহার পাঠিয়েছ? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ প্রতিবেশীর অধিকার প্রসঙ্গে জিবরীল (আঃ) আমাকে অবিরত উপদেশ দিতে থাকেন। এমনকি আমার ধারণা হল যে, হয়ত শীঘ্রই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিবে। [ইরওয়া ৮১১; তিরমিযী ১৯৪৩; আল-আদাবুল মুফরাদ ১০৪, ১২৮]


১১) আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন আল্লাহর রসূল বলেছেন যে, মানুষের প্রত্যেক জোড়ার প্রতি সদকা রয়েছে, প্রতি দিন যাতে সূর্য উদিত হয় দু’জন লোকের মাঝে সুবিচার করাও সদকা, কাউকে সাহায্য করে সাওয়ারীতে আরোহণ করিয়ে দেয়া বা তার উপরে তার মালপত্র তুলে দেয়াও সদকা, ভাল কথাও সদকা, সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে পথ চলায় প্রতিটি কদমেও সদকা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করাও সদকা। [সহিহ বুখারী, হাদিস ২৯৮৯]

 

১২) ফৌজদারি দন্ডবিধি মুসলিম অমুসলিম সকলের জন্য সমান, অপরাধের যে সাজা মুসলিমরা পাবে, সে সাজা অমুসলিমদের উপরও প্রয়োগ হবে। যেমন, কোন অমুসলিম নাগরিক যদি মুসলমানদের জিনিস চুরি করে, এবং কোন মুসলিম যদি অমুসলিম নাগরিকদের জিনিস চুরি করে, তাহলে উভয়ের উপর হাত কাটার বিধান প্রয়োগ হবে” [আল মাবসুত ৯ম খন্ড পৃ- ৫৭-৫৮]


ইসলামে অমুসলিমদেরকে তাদের নিজের ধর্মীয় উৎসব পালনে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আবার মুসলিমদেরকে সেখানে যেতেও মানা করা হয়েছে। কারন ইসলামে সৃষ্টিকর্তার তৈরি করা কোন জীব বা জড় বস্তুর পূজা করা, তার সামনে মাথা নত করা, তার কাছে কিছু চাওয়া, তাদের তাদের উৎসব পালনের জন্য আর্থিক বা শারীরিক ভাবে সাহায্য করা, তাকে সৃষ্টিকর্তা বা তাকে সৃষ্টিকর্তার সমান বা কাছাকছি মনে করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যকারো নামে জবাই বা বলি করা পশুর মাংশ ও তৈরি করা খাবার খাওয়া ইত্যাদিকে স্পষ্ট হারাম করা হয়েছে। আর অমুসলিমদের উৎসবে যাওয়া মানে সেসব বিষয়কে সমর্থন করার শামিল। তাই অমুসলিমদের উৎসব মুসলিমরা কোন ভাবে উৎযাপন করতে পারবে না।

Ashraful Nafiz

I am an ordinary Muslim student who is interested in acquiring the beneficial knowledge given by Allah and hopes to spread that knowledge among the people. facebook youtube twitter instagram quora

3 মন্তব্যসমূহ

Would you tell me something

  1. ভাই আপনার কোন কথার কিছুই বুঝতে পারছি না। যতটুকু বুঝতে পারছি তার উত্তর দিই।

    ইসলাম কোন আইন নয় বরং এটা আল্লাহর মনোনিত ধর্ম, এখানে কেই অপরাধ করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

    ইসলামে দুনিয়ায় কোন অপরাধের কোন শাস্তি প্রধান করা হবে সেই বিধান দেওয়া হয়েছে তাই সেগুলাকে আইন বলা যায়। এখন আপনি দুনিয়ার আইনকে ইসলাম বললেত সেটা হবে না।

    আমাদের জীবন ৩টা দুনিয়া, কবর ও আখিরাত। শেষ বিচারের দিন যে সবাইকে শাস্তি দেওয়া হবে এমনত নয় এছাড়া দুনিয়া ও কবরের পরে যখন কেয়ামতে সব ধ্বংস হয়ে যাবে তার পর শেষ বিচারের দিন আসে এর আগে নয়। সেদিন যে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তাকে জাহান্নামে নেওয়া হবে ও আর যে যোগ্য নয় তাকে জান্নাতে নেওয়া হবে।

    দুনিয়াতে কয়টা অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয়? হাতে গুনা অল্প কয়েকটার শাস্তি দেওয়া হয়। আর এখনত ইসলাম অনুযায়ি কোথাও শাস্তি দেওয়াই হয় না। এছাড়া আমি আপনার মন্তব্য থেকেই বুঝতে পারছি যে আপনার ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান কিছুটা কম কারন অসংখ্যা হাদিস আছে যেখান থেকে বলা যায় মুসলিমদের যে অপরাধের শাস্তি দুনিয়াতে দেওয়া হবে সেই অপরাধের শাস্তি আখিরাতে আর দেওয়া হবে না।

    আশা করি উত্তর পেয়েছেন ধন্যবাদ

    উত্তরমুছুন
  2. আমি আগেও বলেছি দুনিয়ায় তেমন কোথাও শরিয়া আইন নেই। আর শরিয়া আইন অনুযায়ি হত্যা, হাত কাটা, দেশান্তর করা, ক্রশবিদ্ধ করা, বন্ধি রাখা, বেত্রাঘাত করা, রজম করা, কিসাস ইত্যাদি। এখন আপনার কথা মত প্রশ্ন আছে যে আল্লাহ কি একই শাস্তি দিবেন আমাদেরকে আখিরাতে? নাত! আখিরাতের শাস্তি ও বিচারের ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন তাহলে দুনিয়ার শরিয়া আইন ও আল্লাহর আখিরাতের শরিয়া আইন এক কিভাবে হয়? এগুলাকে কিভাবে মিলাতে পারেন?

    তারপর একজন মানুষ ১০জনকে হত্যা করল সে কয়বার শাস্তি পাবে দুনিয়ায়? ১ বার মৃত্যুদন্ড, এটাত একজনকে হত্যা করার শাস্তির মত, আর ৯ জনকে হত্যা করার শাস্তি কি সে পাবে না? একজন ২০ নারীকে ধর্ষন করেছে যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড যা একবারে শেষ ও শুধু একজনের শাস্তি পাওয়ার মত। বাকি নারীদের সাথে যে অন্যায় হয়েছে সেটার কি শাস্তি পাবে না?

    ইসলামে কোন মুসলিমকে কোন অপরাধের জন্য দুনিয়ায় শরিয়া আইন অনুযায়ি শাস্তি দেওয়া হলে সেই অপরাধের শাস্তি আর আখিরাতে দেওয়া হবে না। কিন্তু যদি সে অনুতপ্ত না হয়, যদি সে অমুসলিম হয়, যদি সে এমন কোন অপরাধ করে যেটা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, তাহলেত তাকে আখিরাতে শাস্তি পেতেই হবে।

    উত্তরমুছুন
  3. শরিয়া আইন নেই বলতে আমি বুঝিয়েছি বর্তমানে তেমন কোথাও প্রয়োগ নেই থাকলেও খুব কম।

    শরিয়াহ আইন কোরআন ও হাদিস থেকে বাস্তবায়ন করা হয়, আর যেসব অপরাদের শাস্তি কোরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট করে বলা নেই সেগুলার ব্যপারে দেশিও আইন চলে বা মানব তৈরি আইনে বিচার হয়। এখন যদি কোরআনও ও হাদিস আপনি মানতে না চান তাহলে সেটা আপনার ব্যাপার। আপনার একজনের মতে দেশ চলে না।

    আমি নিশ্চিত দেশে বেশির ভাগ মুসলিম চাইবে শরিয়াহ আইন অনুযায়ি বিচার হোক কিছু মুনাফিক টাইপের মুসলিম ছাড়া। এর কারন শরিয়াহ আইন দিয়ে বিচার ও সঠিক ভাবে প্রয়োগ হয় এবং মানব আইন দিয়ে বিচার হয় এমন দেশ দুটোর ক্রাইন ইন্ডেক্স দেখলেই বুঝতে পারবেন। যদি মানব আইনে বিচার করা যায় তাহলে শরিয়াহ আইনে বিচার করলেত কোন সমস্যা আছে বলে মনে হয় না।

    আমার দৃষ্টিতে মানুষের পরবর্তিতে তৈরি আইনে বিচার না করে ধর্মীয় আইনেই বিচার করাটা উচিৎ। ভারতে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ি, খ্রিষ্টার ধর্মে বাইবেল অনুযায়ি, ইহুদি দেশে তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ি, মুসলিম দেশে মুসলিম শরিয়াহ (কোরআন ও হাদিস) অনুযায়ি বিচার করাটাকে আমি বেশি সঠিক মনে করি।

    উত্তরমুছুন
নবীনতর পূর্বতন