ইসলামে গালাগালি করা হারাম

গালাগালি করা নিয়ে ইসলামের নিষেধাজ্ঞা

আমি প্রায় সময় দেখি যে কোনো নাস্তিকদের বা ইসলাম বিদ্ধেষীদের বা ইসলামের সাথে যায় না এমন পোষ্টের কমেন্টে আমাদের আবেগী মুসলিম অশ্লীল থেকেও অশ্লীল ভাষা ব্যাবহার করে গালাগালি করছে। আপনার জেনে রাখা উচিত, এমন মুর্খতা ও অশালীন সূলভ মন্তব্য খোদ ইসলামেই নিষিদ্ধ। আর ইসলাম এবং মুসলমানদের দুর্নাম ও ইমেজ নষ্ট করে আপনি আরেকটি জঘণ্য পাপ করছেন। অথচ শয়তান আপনার এই নোংরামোকে আপনার কাছে 'ইসলামের খেদমত' হিসেবে উপস্থাপন করছে। আপনারা মনে করতেছেন আপনারা ইসলামের খেদমত করতেছেন ও আপনারা অনেক বড় মুমিন।

ইসলামে গালাগাল করা হারাম, এমনকি অমুসলিমদের প্রাণহীন ও অস্তিত্বহীন উপাস্যকে ও কাফেরদেরকে এবং শয়তানকে গালি দেওয়াও নিষিদ্ধ ইসলামে।  

কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, “আর আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমলংঘন করে অজ্ঞানতাবশতঃ আল্লাহকেও গালি দেবে” [সূরা আল আন‘আম, আয়াত ১০৮]  

আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! কোন মুমিন সম্প্রদায় যেন অপর কোন মুমিন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং নারীরা যেন অন্য নারীদেরকে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা তারা উপহাসকারিণীদের চেয়ে উত্তম পারে। আর তোমরা একে অন্যের প্ৰতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না, ঈমানের পর মন্দ নাম অতি নিকৃষ্ট। আর যারা তওবা করে না তারাই তো যালিম।” [সূরা হুজুরাত আয়াত ১১]  

সাঈদ বিন যায়দ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা কাফেরকে গালি দিয়ে মুসলিমকে কষ্ট দিয়ো না। [হাদিস সম্ভার ২০৯৩; বাইহাক্বী ৭৪৩৯, হাকেম ১৪২০, সহীহুল জামে’ ৭১৯১]

আবূ হুরাইরা (রা) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল ﷺ বলেছেন, তোমরা শয়তানকে গালি দিয়ো না; বরং ওর অনিষ্ট হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। [হাদিস সম্ভার ২১০২; সহীহুল জামে ৭৩১৮]

যারা গালাগালিতে লিপ্ত তাদের সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসিকী এবং তাকে হত্যা করা কুফুরী।  [বুখারি ৬০৪৪, ৭০৭৬ সহীহ মুসলিম ১২৫, তিরমিজি ১৯৮৩]  

রাসুল ﷺ আরো বলেছেন:- ‘পরষ্পর গাল-মন্দকারী ব্যক্তিদয় দুটি শয়তান। তারা পরষ্পরের নিন্দা করে এবং মিথ্যা কথা বলে’ [মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১৬৮৩৬]

আমাদের সমাজে বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদের এই দেশগুলোতে মা-বাবাকে নিয়ে গালাগালি বেশি শুনা যায়। এই সম্পর্কে রাসুল ﷺ ইরশাদ করেছেন, ‘কবিরা গুনাহগুলোর একটি হলো নিজের মা-বাবাকে অভিশাপ করা।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহর রাসুল! মানুষ নিজের মা-বাবাকে কিভাবে অভিশাপ করে?’ তিনি বললেন, ‘যখন সে অন্যের বাবাকে গালাগাল করে, তখন সে নিজের বাবাকেও গালাগাল করে থাকে। আর যে অন্যের মাকে গালি দেয়, বিনিময়ে সে তার মাকেও গালি দেয়।’ [বুখারি ৫৯৭৩, তিরমিজি ১৯০২]  

গালাগাল করায় গুনাহের ভয়াবহতা নিয়ে বেশ কিছু হাদিস পাওয়া যায়। তার মধ্যে আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ দু’ব্যক্তি যখন গালমন্দে লিপ্ত হয় তখন তাদের উভয়ের গুনাহ তার উপরই বর্তাবে, যে প্রথমে শুরু করে; যতক্ষণ না অত্যাচারিত সীমালঙ্ঘন করে। [সহিহ মুসলিম হাদিস, একাডেমি নাম্বারঃ ৬৪৮৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮৭]  

আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন- যে ব্যক্তি (কোন মুসলিম) ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করেছে অথবা কোন বিষয়ে যুলুম করেছে, সে যেন আজই (দুনিয়াতে) তার কাছে (ক্ষমা চেয়ে) হালাল করে নে- ঐদিন আসার আগে, যেদিন টাকা পয়সা কিছু থাকবে না। তার যদি কোন নেক আমল থাকে, তবে তার জুলুমের পরিমাণ অনুযায়ী তা থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। তবে তার সঙ্গীর পাপরাশি তার (জালেমের) উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। [বুখারি হাদিস ২৪৪৯,৬৫৩৪, মুসনাদ আহমাদ হাদিস ৯৩৩২]  

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন চারটি স্বভাব যার মধ্যে রয়েছে সে সত্যিকার মুনাফিক; যার মধ্যে উক্ত চারটির একটিও থাকে সে তা না ছাড়া পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকীর একটি স্বভাব রয়ে যায়। (১) সেকথা বললে মিথ্যা বলে, (২) চুক্তি করলে তা ভঙ্গ করে, (৩) ওয়াদা করলে খেলাফ করে এবং (৪) যখন বিবাদে লিপ্ত হয়, গাল-মন্দ করে। [সহিহ বুখারী, হাদিস ৩৪; সহিহ মুসলিম ১০৬]  

সুলাইমান ইবনু সুরাদ (রা) নামক নবী ﷺ এর এক সাহাবী হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ দু’জন লোক নবী ﷺ এর সম্মুখে পরস্পর গালাগালি করছিল। তাদের একজন এতই রাগান্বিত হয়েছিল যে, তার চেহারা ফুলে বিগড়ে গিয়েছিল। তখন নবী ﷺ বললেনঃ আমি অবশ্যই একটিই কালেমা জানি। সে ঐ কালেমাটি পড়লে তার রাগ চলে যেত। তখন এক লোক তার কাছে গিয়ে নবী ﷺ এর ঐ কথাটি তাকে জানালো আর বললো যে, তুমি শয়তান থেকে আশ্রয় চাও। তখন সে বললোঃ আমার মধ্যে কি কোন রোগ দেখতে পাচ্ছ? আমি কি পাগল? চলে যাও তুমি। [সহিহ বুখারি ৬০৪৮] 

কেউ যদি আগে ঝগড়া/গালি শুরু করে তার ব্যাপারে হাদিসে ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত  নবী ﷺ বলেছেন, ‘যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় এবং এমন দোষে অপমানিত করে যা তোমার মধ্যে আছে, তাহলে তাকে তুমি এমন দোষে অপমানিত করো না/গালি দিও না যা তার মধ্যে আছে। তাহলে তার সাওয়াব তুমি পাবে এবং তার গুনাহ তারই থাকবে।’ [মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২০৬৩২; সহিহুল জামে, হাদিস ৫৯৪]  

জাবের বিন সুলাইম হুজাইমি (রা) বলেন, নবী ﷺ বলেছেন, ‘...যদি কোনো ব্যক্তি তোমাকে গালি দেয় এবং যে ত্রুটি তোমার মধ্যে নেই— তা নিয়ে তোমাকে লজ্জা দেয়, তাহলে তুমি তাকে সেই ত্রুটি নিয়ে ওকে লজ্জা দিয়ো না, যা ওর মধ্যে আছে। ওকে উপেক্ষা করে চল। ওর পাপ ওর উপর এবং তোমার পুণ্য তোমার জন্য। আর অবশ্যই কাউকে গালি দিয়ো না। [ইবনে হিব্বান, ৫২১, ত্বায়ালিসি ১২০৮, সহিহুল জামে, হাদিস ৯৮]  

আল্লাহর রাসুল ﷺ আরো বলেছেন- মু’মিন কখনো দোষারোপকারী ও নিন্দাকারী হতে পারে না, অভিসম্পাতকারী হতে পারে না, অশ্লীল কাজ করে না এবং কটুভাষীও হয় না। [তিরমিজি, ১৯৭৭] এমনই আরেকটা হাদিস আছে যেখানে রাসুল ﷺ ইরশাদ করেন:- ‘মুমিন ব্যক্তি কারো সন্মানে আঘাত করে না। কাউকে অভিশাপ দেয় না। অশ্লীল কাজ করে না। মন্দ কথা বলে না’ [তিরমিজি, হাদিস ২১০৫] 

তাই তিনি উপদেশ দিয়েছেন মুসলিমকে যে কাউকে গালি দিবে না ও ভালো কাজে কার্পণ্য করবে না। [মুসনাদে আহমাদ ২১১৭৮]

এমনি একটি হাদিসে পাওয়া যায় যে, লাক্বীত্ব বিন ছাবেরাহ (রা) বলেন, ‘একদিন আমি রাসূল -কে বললাম, আমার একজন স্ত্রী রয়েছে যে নোংরা কথা বলে ও গালি-গালাজ করে। তিনি বললেন, তালাক দিয়ে দাও। আমি বললাম, তার ঘরে আমার একটি সন্তান রয়েছে এবং সে আমার পুরানো সঙ্গিনী। তিনি বললেন, তাকে উপদেশ দাও। যদি তার মধ্যে কোন কল্যাণ থাকে, তাহ’লে সে তা গ্রহণ করবে। তবে তুমি তোমার শয্যাসঙ্গিনীকে বাঁদীর ন্যায় মারবে না’ [আবু দাঊদ ১৪২; মিশকাত ৩২৬০]

এমনকি মৃতকেও গালি দিতে মানা করা হয়েছে। যেমন হাদিসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ  বলেছেন, তোমরা মৃতদেরকে গালি দিয়ো না। যেহেতু তারা নিজেদের কৃতকর্মের পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।(অর্থাৎ, তার ফল ভোগ করছে। [সহিহ বুখারি ১৩৯৩; হাদিস সম্ভার ২০৯১] আরেক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেছেন, “তোমরা মৃতদেরকে গালি দিয়ে জীবিতদেরকে কষ্ট দিয়ো না।” [আহমাদ ১৮২১০, তিরমিযী ১৯৮২] 

হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে গালাগালি সম্পূর্ণ হারাম। তাহলে অশালীন বা ইসলাম বিরোধী কোন পোষ্টে আপনারা কি করবেন? সেই সব ধরনের পোস্টে যুক্তিনির্ভর ও শালীন মন্তব্যের মাধ্যমে নিজের বক্তব্য বা মতামত জানানো উচিত। কোরআন ও হাদীস দেখে তার ভুল শোধরানোর চেষ্টা করা উচিত। সে সামর্থ্য না থাকলে নিছক জেদ মেটানোর জন্য কটু মন্তব্য করা মানে মুসলিমদের বদনাম করা। এমন আচরণে মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে না, বরং ইসলাম থেকে আরো দূরে সরে যাবে।

একটা অনুরোধ করব পারলে এসব মানুষদের সাথে যুক্তি,প্রমান দিয়ে তর্ক করিয়েন কিন্তু গালাগালি করিয়েন না। কারন আমরা তাদেরকে গালাগালি করার কারনে তারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় না বরং ইসলামের প্রতি তাদের ঘৃনা বেড়ে যায়। ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ:) যথার্থই বলেছিলেন-ইসলামের প্রতি আমাদের আবেগ অনেক বেশি, জ্ঞান কম। মহান আল্লাহ আমাদের প্রকৃত মুমিনের গুণাবলী অর্জনের তাওফিক দান করুন।

শুধু আবেগি মুসলিম বলে কথা না রাস্তাঘাটে যাকে দেখা যায় সেই গালাগলি করে। সামান্য কথা কাটাকাটি হলেও মা-বাবা নিয়ে গালাগালি শুরু করে মানুষ। আর যুব সমাজত বন্ধুবান্ধবের সাথে মসকারি করার নামে অশ্লিলতা, বেহায়াপনা ও গালাগালি ছাড়া কিছু করে না। শুধু তাই নয়, বর্ত মানেত গালাগালিত একটা ট্য়রেন্ডিং এ রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন নাটক, মুভি, ওয়েভ সিরিজ, টেলিফিল্ম, সিরিজ ইত্যাদিতে গালাগালিকে একটা নরমাল বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মানুষ হয়ত এখন গালাগালিকে নিজের জীবনের একটা অংশ বানিয়ে নিয়েছে, এটাকে খুব সাধারন জিনিস মনে করছে, হয়ত অনেকে এটাকে কুল মনে করে, হয়ত ভাবে যে যত গালি দিতে পারে সেই তত বেশি স্মার্ট। আফসোস এরা শুধু নামেই মুসলিম হয়ে রইল!

Ashraful Nafiz

I am an ordinary Muslim student who is interested in acquiring the beneficial knowledge given by Allah and hopes to spread that knowledge among the people. facebook youtube twitter instagram quora

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Would you tell me something

নবীনতর পূর্বতন