ঐক্যের প্রতি আল্লাহর পবিত্র কুরআনের আহ্বান ও মুসলিমদের পরস্পর আচরনে মহানবীর আদেশ

আজ আমার মুসলিম ভাইদের মধ্যে কতটা দূরত্ব! কতটা হিংসা-বিদ্বেষ! অতটা অনৈক্য! কতটা ঘৃণা! মাযহাবি, আহলে হাদিস, সুন্নি, ওহাবি, চরমোনাই, দেওবন্দ, চিশতি, জামায়াত, নিরপেক্ষ ইত্যাদি। আমরা সবসময় নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাধ, কাদা-ছোড়াছুড়ি, গালাগালি, গিবত, হিংসা,বিদ্বেষ, মারামারি ইত্যাদির মধ্যে ব্যস্ত থাকি। আমরা একমুসলিম আরেক মুসলিমকে নিজের শত্রু মনে করি অথচ কোরআনে বলা হয়েছে “মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।” [সূরা হুজরাত আয়াত ১০] কিভাবে নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব বাড়ানো যায় সেটার উত্তরও কোরআনে দেওয়া আছে, “আর ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন তা দ্বারা যা উৎকৃষ্ট; ফলে আপনার ও যার মধ্যে শক্ৰতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত।” [সূরা হামিম সেজদা আয়াত ৩৪]

 
কেউ দলিলের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন মত পোষন করতেই পারে তার মানে এই না যে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। আমাদের উচিৎ অপর মতকে সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা, মনোযোগ সহকারে শুনা ও সঠিক কিনা তা যাচাই করা  তারপর গ্রহন যোগ্য মনে হলে গ্রহন করবে না হয় করবে না। আমাদেরকে একটা বিষয় খেয়াল রাখা উচিৎ মুসলিমদের ক্ষতি করার জন্য অমুসলিম সবাই এক হয়ে যায় তাই আমাদেরকে নিজেদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে হবে, একজনের বিপদে আরেক জনকে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে মুসলিমরা যত সফলতা পেয়েছে তার কোনটা ঐক্য ছাড়া সম্ভব হয় নি।
 
ইহুদি-খৃষ্টানরা ডিবেট করে কিভাবে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়া যায় সেটা নিয়ে, আর এদিকে আমরা বর্তমান মুসলিমরা ডিবেট করি অতি সামান্য বিষয় ও আমল মানা বা না মানা নিয়ে। যেমন নামাজে হাত বাঁধার স্থান কোথায়, রফাদাইন করা, তাবিজ যায়েজ নাকি নাযায়েজ, সম্মিলিত মোনাজাত, ঈদের নামাজে কয় তাকবির, মসজিদে মেয়েদের যাওয়া নিয়ে, টুপি পরা, জুব্বা পরা, মাযহাব, জেনারেল লাইনে শিক্ষিত ইসলামিক ব্যাক্তিত্ব বনাম আরবি লাইনে শিক্ষিত ইসলামিক ব্যাক্তিত্ব, নবী কিসের তৈরি, নবীর মা-বাবা জান্নাতি না জাহান্নামি, ঈদেমিলাদুন্নবি মানা না মানা, হাটতে-বসতে দুরুদ পড়া যাবে কি যাবে না ইত্যাদি। আমরা আছি এসব নিয়ে কামরাকামরির মধ্যে ব্যাস্ত, বাহ কি চমৎকার! এসব কারনে আমাদের মধ্যে এতটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে এবং অমুসলিমরা এসববের কারনে মুসলিমদেরকে অপমান ও অসম্মান করতে আরো উৎসাহ এবং সাহস পায়। এই কাজগুলা বিশেষ করে আমাদের আলেম সমাজ করে থাকে এবং তাদের কারনে সাধারন মুসলিমরাও একই কাজ করে।

সাধারন মুসলিমরা আলেমদের কারনে নিজেরাও ঝগড়া শুরু করে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে এবং অপমান, গালাগালি ইত্যাদি করে। আপনারাই বলুন কাউকে অপমান করা ও গালাগালি করা কি মুসলিমদের কাজ? দয়া করে এসব থেকে বিরত থাকুন ও অন্য মতকে সম্মান দিতে শিখুন যদি পারেন সুন্দর ভাষায় দলিল দিয়ে ভিন্ন মতের মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করুন কারন আল্লাহ বলেছেন, 

“আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায় নিশ্চয় আপনার রব, তার পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়েছে, সে সম্বন্ধে তিনি বেশী জানেন এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি ভালভাবেই জানেন।” [সুরা নাহল : আয়াত ১২৫]

আমাদের আলোচনা করার দরকার ছিল কিভাবে নতুন প্রজন্মকে দুনিয়ার জ্ঞানের সাথে ইসলামের জ্ঞান দেওয়া যায়, শিক্ষা ব্যবস্থায় নাস্তিকতার যে প্রভাব সেটা কিভাবে দূর করা যায়, শাসন ব্যবস্থায় বৈধ শাসক কিভাবে আনা যায়, নিজেদের মধ্যে কিভাবে ঐক্য আনা যায়, সুদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে কিভাবে সুদ মুক্ত করা যায়, বড় বড় সেক্টরে কিভাবে মুসলিমরা অংশ গ্রহন ও সাফল্য লাভ করতে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। আমাদের দেশে মাজারে,মসজিদে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে মুসলিমদের মধ্যে শিরক ডুকে যাচ্ছে সেটা কিভাবে বন্ধ করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা হওয়ার দরকার ছিল, এই দেশ মুসলিমদেশ হিসেবে কিভাবে বাংলাদেশকে  শক্তিশালী মুসলিম দেশ করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার ছিল। এই দেশে এত অপরাধ! এগুলা কিভাবে কমানো যায় সেটা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আফসোস আমরা ছােট খাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে আছি। আগে মুসলিমরা এক ছিল, কোন মাসলা মাসায়েল নিয়ে সমস্যা হলে ইসলামিক স্কলাররা নিজেদের মধ্যে সমাধান করে ফেলত। ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক-বির্তক করত না ও সারা জীবন সেটা নিয়ে ঝগড়া করত না। তাই সেই সময় ছিল মুসলিমদের যুগ, ইসলামের যুগ। তখন মুসলিরা পুরো পৃথিবীতে সবার থেকে এগিয়ে ছিল।

ভাইজান, ছোট মুখে একটা কথা বলি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি সম্পর্ণ ব্যক্তিদের উঠিয়ে আনার জন্য ডিবেট করুন। ভালো জিনিস নিয়ে ডিবেট করেন, মুসলিম-অমুসলিমের মধ্যে ডিবেট করুন, যেই ডিবেটে জ্ঞান বাড়বে সেটা নিয়ে ডিবেট করে। আর মাসলা মাসায়েল নিয়ে ইসলামিক স্কলাররা জনসম্মুখে আলোচনা না করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমাধান বের করুন। কারন আপনারা যে ডিবেট করছেন সেটাকে সমাধান বের হচ্ছে না বরং দূরত্ব আরো বাড়ছে। আর এসব ডিবেট শেষ হওয়ার পর সবাই মনে করে সে জিতে গেছে কিন্তু আসলে সেখানে কেউই পরাজয় শিকার করে না বা এটা মানে না যে সে আসলে ভুল ছিল।

আমরা নাকি সবাই কোরআন হাদিস মেনে চলি। কিন্তু কোরআনে আল্লাহ বলেছেন -

✒ আর তোমরা সকলে আল্লাহ্‌র রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। [সুরা আলে-ইমরান:১০৩]

✒ নিশ্চয় যারা তাদের দ্বীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন কাজের সাথে আপনার(নবীর) কোন সম্পর্ক নেই। তাদের বিষয় তো আল্লাহ্‌র নিকট তারপর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানাবেন। [আল-আন'আম, আয়াতঃ ১৫৯]

✒ তোমরা  সেসব লোকদের মতো হয়ো না, যাদের কাছে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নানা ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। [সূরা আল ইমরান: ১০৫]

✒ আর তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর, এবং নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবে না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। আর তোমরা ধৈর্য ধারণ কর নিশ্চয় আল্লাহু ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। [সুরা : আনফাল, আয়াত : ৪৬]

✒ হে মুমিনরা, আল্লাহর, তার রাসুলের এবং তোমাদের অভিভাবকদের আনুগত্য করো। তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তবে তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের ওপর বিষয়টি ন্যস্ত করো যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাকো। এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা এবং এর পরিণামও সর্বাপেক্ষা শুভ। [সুরা নিসা, আয়াত : ৫৯]

মুসলিমরা পরস্পর কেমন হবে সেই ব্যাপারে হাদিসে এসেছে - 

✒ ‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেকী এবং তার সাথে লড়াই করা কুফারী।” [বুখারী: ৬০৪৪, মুসলিম: ৬৩] 

✒ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জান, মাল ও ইজ্জত হারাম।” [মুসলিম: ২৫৬৪, কিতাবুল বিরর ওয়াসসিলাহ, তিরমিযী: ১৯২৭] 

✒ ‘তোমরা অনুমান থেকে বেঁচে চলো। কেননা অনুমান বড় মিথ্যা ব্যাপার। আর কারো দোষ খুঁজে বেড়িয়ো না, গোয়েন্দাগিরি করো না, পরস্পরকে ধোঁকা দিয়ো না, আর পরস্পরকে হিংসা কোরো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ কোরো না এবং পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ কোরো না; বরং সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৬]

✒ রাসূলুল্লাহ  বলেছেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার উপর অত্যাচার করবে না এবং তাকে অত্যাচারীর হাতে ছেড়ে দেবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কোনো এক বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বহু বিপদের একটি বিপদ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন।’’ [বুখারি২৪৪২, মুসলিম ২৫৮০, তিরমিযি ১৪২৬, নাসায়ি ৪৮৯৩, আহমদ ৫৩৩৪, ৫৬১৪]

✒ রাসূলুল্লাহ  আমার থেকে তিনটি বিষয়ে “বাই’আত” নিয়েছেন। এক, সালাত কায়েম করবো। দুই, যাকাত আদায় করতে থাকবো। তিন, প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করবো।” [বুখারী: ৫৫]

✒ নবী  আরো বলেছেনঃ এক মুসলিম আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার ওপরে জুলুম করে না, তাকে সহযোগিতা করা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোন ব্যক্তির জন্য তার কোন মুসলিম ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করার মত অপকৰ্ম আর নাই। [মুসনাদে আহমাদ: ১৬/২৯৭, ৭৭৫৬]

✒ রাসূল  আরো বলেন, ঈমানদারদের সাথে একজন ঈমানদারের সম্পর্ক ঠিক তেমন যেমন দেহের সাথে মাথার সম্পর্ক। সে ঈমানদারদের প্রতিটি দুঃখ-কষ্ট ঠিক অনুভব করে যেমন মাথা দেহের প্রতিটি অংশের ব্যথা অনুভব করে। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৪০]

✒ রাসুলুল্লাহ  বলেন, ‘এক মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই, না সে তার প্রতি জুলুম করবে, না তাকে অন্যের হাওলা করবে। যে কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তাঁর প্রয়োজন পূরণ করবেন। ’ [সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৯৫১]

✒ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পারস্পরিক ভালবাসা, সুসম্পর্ক এবং একে অপরের দয়ামায়া ও স্নেহের ব্যাপারে মুমিনগণ একটি দেহের মত। দেহের যে অংগেই কষ্ট হোক না কেন তাতে গোটা দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় ভুগতে থাকে ৷ [বুখারীঃ ৬০১১, মুসলিম: ২৫৮৬]

✒ কোন মুসলিম যখন তার ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দোআ করে তখন ফেরেশতা বলে, আমীন। (কবুল কর।) আর তোমার জন্যও তদ্রূপ হোক। [মুসলিম: ২৭৩২]

✒ নবী  বলেন, মুমিনগণ পরস্পরের জন্য একই প্রাচীরের ইটের মত একে অপরের থেকে শক্তিলাভ করে থাকে। [বুখারী: ২৬৪৬, মুসলিম: ২৫৮৫] 

✒ একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, সে তার উপর অত্যাচার করতে পারে না আবার তাকে ধ্বংসের মুখেও ঠেলে দিতে পারে না। [বুখারী: ২৪৪২, মুসলিম: ২৫৮০]

✒ প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার মানুষের আমল (আল্লাহর দরবারে) উপস্থিত করা হয়। সেদিন আল্লাহ তাআলা এমন সকলকেই ক্ষমা করে দেন, যে তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করে না। তবে তাকে ছাড়া, যার এবং তার ভাইয়ের মাঝে বিদ্বেষ থাকে। তখন বলা হয়, এই দুইজনকে পিছিয়ে দাও, যতক্ষণ না তারা পরস্পর মিলে যায়, এই দুইজনকে পিছিয়ে দাও, যতক্ষণ না তারা মিলে যায়। [সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৫]

✒ পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দেওয়া। আর পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া তো (দ্বীনকে) মুণ্ডিয়ে দেয়। [আবু দাউদ, হাদীস ৪৯২১, তিরমিযী, হাদীস ২৫০৯]

এমন আরো শত শত কোরআনের আয়াত ও হাদিস পেশ করা যাবে। যদি আসলেই মুসলিম হয়ে থাকেন তাহলে ঝগড়া করে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়াবেন না। আল্লাহকে ভয় করুন ও এসব ফেতনা থেকে ফিরে আসুন, মুসলিম উম্মাকে আর বিভক্ত করবেন না দয়া করে।
Ashraful Nafiz

I am an ordinary Muslim student who is interested in acquiring the beneficial knowledge given by Allah and hopes to spread that knowledge among the people. facebook youtube twitter instagram quora

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Would you tell me something

নবীনতর পূর্বতন