কোরআন কি রাত ও দিনের কক্ষ পথ আছে বলে? সূর্যের কোন কক্ষ পথ নেই?

এক মুসলিম ভাই আমাকে একজন ইসলাম বিদ্বেষী ভাইয়ের সূরা আম্বিয়া আয়াত ৩৩ ও সূরা ইয়াসিন আয়াত ৪০ নিয়ে উলটাপালটা কিছু অভিযোগ করা স্ক্রিনসট দেখায় যেখানে যে বলে, কোরআন রাত ও দিনের কক্ষ পথ আছে বলে কিন্তু বিজ্ঞান বলে দিন ও রাতের কক্ষ পথ নেই এগুলা চাঁদ ও সূর্যের কারনে হয় তারপর তার আরো একটা অভিযোগ ছিল কোরআন বলে সূর্য ঘোরে ও সেটার কক্ষ পথ আছে কিন্তু বিজ্ঞান বলে সূর্য ঘুরে না ও তার কোন কক্ষপথও নেই। তখন সেই ইসলামবিদ্বেষী ভাইয়ের জন্য আমি মুসলিম ভাইটির কাছে যে উত্তর দিলাম তা নিছে বিস্তারিত বর্ণনা করা হল-


وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ  (সূরা আম্বিয়া)

এবং তিনিই সেই সত্তা, যিনি রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্র সৃষ্টি করেছেন। সবই এক ফলকে সাতার কাটছে। 

আল্লাহ্ই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিবস এবং সূর্য ও চন্দ্র ; প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে। 

তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত ও দিন, সূর্য আর চন্দ্র। প্রত্যেকেই তার চক্রাকার পথে ভেসে বেড়ায়।

لَا الشَّمۡسُ یَنۡۢبَغِیۡ لَهَاۤ اَنۡ تُدۡرِکَ الۡقَمَرَ وَ لَا الَّیۡلُ سَابِقُ النَّهَارِ ؕ وَ کُلٌّ فِیۡ فَلَکٍ یَّسۡبَحُوۡنَ (সূরা ইয়াসিন)

সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, আর প্রত্যেকেই কক্ষ পথে ভেসে বেড়ায়। 

সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চাঁদকে ধরে ফেলা, আর রাতের পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে ছাড়িয়ে আগে বেড়ে যাওয়া, প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষ পথে সাঁতার কাটছে। 

সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া এরং রাতের পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা; এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সাতার কাটে।

প্রথমেই কয়েকটা তাফসীরে এই আয়াত নিয়ে কি বলা আছে তা দেখেনিই।

১. কক্ষপথে সাঁতার কাটছে '। কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত শব্দ হল فلك যার প্রকৃত অর্থ বৃত্ত। এ আয়াত যখন নাযিল হয়েছে, তখন জ্যোতির্বিজ্ঞানে টলেমিক মতবাদের জয় - জয়কার। টলেমির মতে চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ - নক্ষত্র আকাশমণ্ডলের সাথে সংস্থাপিত। ফলে আকাশের ঘুর্ণনের সাথে নক্ষত্ররাজিও অনিবার্যভাবে ঘুরছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে যে শব্দমালা ব্যবহার করেছেন, তা টলেমির চিন্তাধারার সাথে পুরােপুরি খাপ খায় না। বরং এ আয়াতের বক্তব্য মতে প্রতিটি নক্ষত্রের নিজস্ব গতিপথ আছে। প্রত্যেকে আপন - আপন গতিপথে সন্তরণ করছে। সন্তরণ করা ’ শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। এর দ্বারা এটাই প্রকাশ যে, তারা শূন্যমণ্ডলে আবর্তন করছে। ‘ গ্রহ - নক্ষত্ররা শূন্যমণ্ডলে আবর্তন করছে'- এই যে তত্ত্ব কুরআন মাজীদ বহু পূর্বেই জানিয়ে রেখেছে, বিজ্ঞানের এখানে পৌছতে অনেক দিন লেগেছে।   

২. আরবীতে فلك হচ্ছে আসমানের এক পরিচিত নাম। ‘সবই এক ফলকে সাতার কাটছে’ - এই বাক্য থেকে দুটি কথা পরিষ্কার বুঝা যায়। প্রথমতঃ এসব তারকা একই আকাশমন্ডলে অবস্তিত নয়, বরং প্রত্যেকের আকাশ বা কক্ষপথ পৃথক। দ্বিতীয়তঃ ‘ফলক’ অর্থাৎ আকাশ মন্ডল এরূপ কোন জিনিস নয় যার সংগে তারাগুলো খুটিতে বাধার ন্যায় আবদ্ধ হয়ে রয়েছে এবং তা তারাগুলিসহ আবর্তন করছে, বরং আকাশ কোন প্রবহমান তরলের ন্যায় বা ফাকা ও শূণ্যবৎ জিনিস যার মধ্যে তারকা সমূহের গতিশীলতা সাঁতার কাটার সংগে সাদৃশ্যমূলক।
 
৩. তাফসীরে ইবেন কাসীর --وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ অর্থ আর তিনিই তিনি যিনি রাত্রি ও দিন সৃষ্টি করেছেন, মানে একটি তার অন্ধকার এবং নিস্তব্ধতা সঙ্গে, এবং অন্যটি তার আলো এবং মানুষের মিথস্ক্রিয়া সঙ্গে; কখনও কখনও একটি লম্বা হয় যখন অন্যটি ছোট হয়, তারপর তারা পরিবর্তন করে। وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ  অর্থ, সূর্য তার নিজস্ব আলো এবং তার নিজস্ব পথ এবং কক্ষপথ এবং বরাদ্দ সময় এবং চাঁদ যেটি একটি ভিন্ন আলোয় আলোকিত হয় এবং একটি ভিন্ন পথে ভ্রমণ করে এবং তার নিজস্ব বরাদ্দ সময় রয়েছে। كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ প্রতিটি একটি কক্ষপথে ভাসমান মানে, ঘূর্ণায়মান। ইবনে আব্বাস বলেন,"তারা একটি বৃত্তের মধ্যে একটি চরকার মত ঘোরে।" 

৪. তাফসীরে জাকারিয়াতে বলা হয়েছে প্রত্যেক বৃত্তাকার বস্তুকে فلك বলা হয়। এ কারণেই সূতা কাটার চরকায় লাগানো গোল চামড়াকে فلكة المغزل বলা হয়। [বাগভী; ফাতহুল কাদীর] আর একই কারণে আকাশকেও فلك বলা হয়ে থাকে। এখানে সুর্য ও চন্দ্রের কক্ষপথ বোঝানো হয়েছে। “সবাই এক একটি ফালাকে (কক্ষপথে) সাঁতরে বেড়াচ্ছে”—এ থেকে দুটি কথা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে। এক, প্রত্যেকের ফালাক বা কক্ষপথ আলাদা। দুই, ফালাক এমন কোন জিনিস নয় যেখানে এ গ্রহ-নক্ষত্রগুলো খুঁটির মতো প্রোথিত আছে এবং তারা নিজেরাই এ খুঁটি নিয়ে ঘুরছে। বরং তারা কোন প্রবাহমান অথবা আকাশ ও মহাশূন্য ধরনের কোন বস্তু, যার মধ্যে এই গ্রহ-নক্ষত্রের চলা ও গতিশীলতা সাঁতার কাটার সাথে সামঞ্জস্য রাখে।

৫. তাফসিরে হাসানুল বায়ানে বলা হয়েছে অর্থাৎ, সূর্যের জন্য সম্ভব নয় যে, সে চাঁদের কাছাকাছি হবে এবং তার ফলে তার আলো শেষ হয়ে যাবে। বরং উভয়ের নিজ নিজ কক্ষপথ ও আলাদা আলাদা গন্ডিসীমা আছে। সূর্য দিনে ও চাঁদ রাতেই উদিত হয়, কখনও এর ব্যতিক্রম না ঘটা এ কথারই প্রমাণ যে, এ সবের নিয়ন্তা ও পরিচালক একজন আছেন। বরং এরাও এক নিয়ম-সূত্রে আবদ্ধ হয়ে আছে এবং এক অপরের পরে আসতে থাকে।  كُلٌّ বলতে সূর্য, চন্দ্র, অথবা তার সাথে অন্য নক্ষত্রকেও বুঝানো হয়েছে। সব কিছু নিজ নিজ কক্ষপথে পরিক্রমণ করে, তাদের কারো একে অপরের সাথে সংঘর্ষ হয় না।

এগুলা ছিল তাফসির যেখানে তার অভিযোগ করা প্রায় প্রশ্নের উত্তর চলে এসেছে তারপরও এখন আপনাকে বিজ্ঞানের কথা বলি। প্রথমেই বলে নি, যে ব্যাক্তি কোরআনের এই আয়াতগুলো নিয়ে আপনাকে উলটাপালটা তথ্য দিয়েছে তার অর্ধেক কথা সত্য আর অর্থেক মিথ্যা। আমার মনে হয় সে ৭ম/৮ম শ্রেণির বইগুলা পড়ে এসব লিখেছে।  

এই আয়াতে সেই ব্যাক্তির বেশিরভাগ অভিযোগ কক্ষপথ ও সূর্য নিয়ে। কোরআনে বলা হয়েছে গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ ইত্যাদি নির্দিষ্ট কক্ষপথে বা বৃত্তাকার পথে ঘোরে এবং বিজ্ঞানও একই কথা বলে আর এটা জানতে আপনাকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহন করতে হবে না অন্তত মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহন করলেই জানার কথা। 

কোরআনে কোথাও বলা হয়নি যে গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ ইত্যাদি কাউকে কেন্দ্র করে ঘুরে বা ঘুরেনা বরং কোরআনে বলা হয়েছে গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ ইত্যাদি নিজস্ব কক্ষপথে আবর্তন করে মানে এদের নিজের কক্ষপথ আছে যেখানে তারা ভেসে বেড়ায় ও তারা এর বাইরে যায় না। আবার প্রথম আয়াতে রাত-দিন চাঁদ-সূর্য সৃষ্টি করেছেন ও তারা নিজ কক্ষ পথে আবর্তন করে বলা হয়েছে। ভাইটি প্রশ্ন করলেন রাতদিন কিভাবে কক্ষপথে আবর্তন করে। সেই আয়াতের দিকে খেয়াল করলেই দেখা যায় তা ২টি অংশে বিভক্ত। যদি দুটি অংশে বিভক্ত না হয়ে একসাথে থাকত তাহলে আপনি বলতে পারতেন যে আল্লাহ রাত-দিনকেও নিজ কক্ষপথে ঘুরছে বলেছেন। তারপর আল্লাহ বলেছেনই তিনি সূর্য ও চাঁদ সৃষ্টিকরেছেন আর এগুলার কারনেই যে রাত দিন হয় সেটা সবাই যানে, তাফসিরে নির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরন বলতে চক্রাকার পথে বিচরন করা বুঝানো হয়েছে, সেই ক্ষেত্রে কথাটি আল্লাহ চাঁদ ও সূর্যে জন্য বলে থাকতে পারেন আবার রাত-দিনে, চাঁদ-সূর্য সবগুলার ক্ষেত্রেও বলে থাকতে পারেন। কারন চাঁদ ও সূর্যের কারনেই রাত ও দিন হয়, আবার রাত ও দিন নির্দিষ্ট সময় পরপর হয় ও ধারাবাহির ভাবে হয় সেটার কারনেও সেদিক থেকে রাতদিনের নির্দিষ্ট কক্ষপথে (চক্রাকারে) বিচরন অযৌক্তিক বলা যায় না। পৃথিবী নিজ কক্ষপথে ঘূর্ণণের কারণেই (আবর্তন বা চক্রাকার)-দিন রাত্রি সৃষ্টি। পৃথিবীর ঘূর্ণণের সাথে রাত্র দিনও ক্রমহারে ঘুরে। অতএব রাত দিন ঘুরে (চক্রাকারে) বা বিচরণ করে।
 
এই কথা যদি একজন নামকরা বিজ্ঞানী বা মনিষি বলত তাহলে কেউ এই প্রশ্ন করতনা কারন তারা যানে যে এই কথা দিয়ে কাকে মিন করা হয়েছে বা এই কথার হারারো ব্যখ্যা থাকতে পারে। ২য় আয়াতেই আল্লাহ বলেছেন প্রত্যেক জিনিস নিজ নিজ কক্ষপথে ভেসে বেড়ায়, এই আয়াতেকি মানুষ, প্রাণী, গাছ, পাথর, পানি, আগুন, আলো, শক্তি, বায়ু ইত্যাদিকেও বুঝিয়েছে? না, এই আয়াতে শুধু সেগুলোকেই বুঝিয়েছে সেগুলা মহাবিশ্বে অবস্থান করে ও যারা প্রদক্ষিণ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমার এই ইসলাম বিদ্বেষী ভাইটি কোরআনের এই আয়াতের মূল অর্থ বুঝেও না বুঝার ভান করছে, ইসলাম থেকে মানুষকে বিমুখ করার চেষ্টা করছে, জেনেশুনে কোরআনের অপব্যখ্যা করছে ও আপনাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। যাইহোক, কোরআনে এই বৃত্তাকার পথ কত বড় বা কত ছোট বা কেমন তা উল্লেখ নেই তাই অনায়েশে বলা যায় সূর্যও নিজের যায়গায় ঘোরে বৃত্তাকার পথে যা বিজ্ঞানও আবিষ্কার করেছে। প্রমান- রেফারেন্স ১ 

আর আপনি যেনে অবাক হবেন যে মহাবিশ্বে প্রায় প্রতিটা জিনিস কোননা কোন জিনিসের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে। আসলে সৌরজগতের গ্রহরা যেমন সূর্যের চারদিকে ঘুরে থাকে তেমনি সূর্য নিজের চারিদিকে ঘোরার পাশাপাশি আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথের ভেতর দিয়ে নিজস্ব কক্ষপথে গ্যালাক্টিক সেন্টার এর চারদিকে প্রদক্ষিণ করে। এখানেও কোরআনে যা বলা হয়েছে তা সঠিক প্রমানিত হয়। প্রমান- রেফারেন্স ২

আশা করি উত্তর পেয়ে গেছেন। আমি জানি সে এই উত্তর পেয়েও মানতে চাইবে না কারন সে নিজের সংশয় দুর করার জন্য নয় বরং ইসলামের জন্য বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য কথাগুলো বা প্রশ্নগুলো করেছে।

Ashraful Nafiz

I am an ordinary Muslim student who is interested in acquiring the beneficial knowledge given by Allah and hopes to spread that knowledge among the people. facebook youtube twitter instagram quora

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Would you tell me something

নবীনতর পূর্বতন