প্রাণের আবির্ভাব স্রষ্টা ছাড়া হওয়া কতটুকু সম্ভব? মানুষ কৃত্রিম জীবন সৃষ্টি করতে পেরেছে?

সময়ের বিখ্যাত নাস্তিক বিজ্ঞানী ও সাধারণ নাস্তিক জনগণের দাবি, "হয়তো আনুমানিত ৪শত কোটি বছর আগে পানিতে নিজ থেকে আপনা আপনি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি, তারপর সেই এক কোষী প্রাণ থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে বহুকোষী প্রাণের সৃষ্টি হয়।" আবার অনেকের ধারণা, “জীবের উৎপত্তি হয়ত নিজ থেকে আপনা আপনি ভাবে জড় বস্তু থেকে হয়েছে।” এখানে "হয়তো" শব্দটি ব্যবহার করে তারা যা বলেন তা শুধুমাত্র তাদের ধারণা! প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরনের বক্তব্য কি আদৌও গ্রহণযোগ্য কিনা? 

Table of Contents

{tocify} $title={Table of Contents}

প্রাণ বা রুহ কি? এটা 'প্রাণশক্তি' সেই শক্তি বা সেই জিনিস যা জড়কে জীবিত করে তুলতে সক্ষম। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, আপনার হাতের স্মার্টফোনটির হার্ডওয়্যারটি জড়। যতক্ষণ এতে সফটওয়্যার ইনস্টল না করা হবে, ততক্ষণ এটি কাজ করবেনা। তেমনি, মানুষের দেহটিকে হার্ডওয়্যার এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যা জড়। মানুষের প্রাণ বা জীবনকে সফটওয়্যার এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। 

আরেকটু পরিষ্কার ধারণার জন্য একটু হাইপোথেটিক্যাল উদাহরণ দেই: মনে করুন, যদি আমরা প্রাণ এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে সঞ্চারণ করতে পারতাম, তবে যেকোনো জড় বস্তুকে জীবন দান করতে পারতাম। এমনকি মৃতকেও জীবিত করতে পারতাম। ধরুন, একটি টেবিলে আপনি প্রাণের সঞ্চারণ করলেন, ফলে টেবিলটি জীবিত হয়ে গেলো! একটি বইতে জীবন সঞ্চারণ করলেন, ফলে বইটি জীবন্ত হয়ে উঠলো! 'জীবন' কিংবা 'প্রাণশক্তি' মূলত এমনই। যদিও বাস্তবে এটা সম্ভব না, কারণ, আমাদের হাতে সেই ক্ষমতা নেই এবং বই বা টেবিলের ক্ষমতা নেই সেই 'প্রাণ' কে ধারণ করার। কাউকে রুহ দেওয়াত মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিন্তু সামান্য দেহ সৃষ্টি করাও মানুষের পক্ষে অসম্ভব বললেই চলে।

তোমরা কেমন করে আল্লাহকে অস্বীকার করছ? অথচ তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ। অতঃপর তিনিই তোমাদেরকে প্রাণ দান করেছেন, আবার মৃত্যু দান করবেন। পুনরায় তোমাদেরকে জীবনদান করবেন। অতঃপর তারই প্রতি প্রত্যাবর্তন করবে। [সুরা বাকারা আয়াত ২৮] 
আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ শস্য-বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী, তিনিই প্রাণহীন থেকে জীবন্তকে বের করেন এবং জীবন্ত থেকে প্রাণহীন বেরকারী। তিনিই তো আল্লাহ্‌, কাজেই তোমাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে?” [সূরা আনআম, আয়াত ৯৫]

নিজ থেকে আপনা আপনি প্রাণ সৃষ্টি!!

বিজ্ঞানীরা কি আজ পর্যন্ত কৃত্রিম প্রাণ সৃষ্টিতে সফল হয়েছে? আধুনিক বিশ্বের সর্বাধুনিক ল্যাবরেটরিতে সবচেয়ে অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীরা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও যদি কৃত্রিম প্রাণের সৃষ্টি না করতে পাড়ে তবে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও বিরূপ পরিবেশে কীভাবে প্রাণের সৃষ্টি হলো কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া? ধরে নিলাম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল নিয়ন্ত্রক ছাড়াই! সেই এককোষী প্রাণ থেকে কি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর সৃষ্টি সম্ভব? জবাব হচ্ছে "না" কখনোই সম্ভব নয়। যদি স্রষ্টা ছাড়া প্রাণের সৃষ্টি সম্ভব না হয় তবে অবশ্যই একজন স্রষ্টা রয়েছে যিনি অসীম মমতায়, অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় গঠন করেছেন এই মহাবিশ্ব ও সৃষ্টি করেছেন সকল প্রাণ! আল্লাহ কোরআনে বলেছেন -

আল্লাহ্‌ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর তত্ত্বাবধায়ক। [সূরা যুমার, আয়াত ৬২]
তারা কি স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? নাকি তারা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে না। তোমার রবের গুপ্তভান্ডার কি তাদের কাছে আছে, না তারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণকারী? নাকি গায়েবী বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান আছে যে, তারা তা লিখছে? [সূরা আত-তুর, আয়াত ৩৫-৩৭,৪১]

বিজ্ঞানী David Abel-এর ভাষায় কোয়ান্টাম ওয়ার্ল্ডের কোন ইভেন্ট-এর ইউনিভার্সাল প্লসিবিলিটি ম্যাট্রিক্স হল ১০^১৪০। [1] অর্থাৎ, কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা যদি  ১০^১৪০-এর মধ্যে একবার হয় এবং উক্ত ঘটনা ঘটার জন্য মহাবিশ্বের সকল পার্টিকেল ও সকল সময় ব্যবহার করার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে ঘটনাটি একবার হলেও ঘটবে। কিন্তু, কোন ঘটনা এই সীমাকে ছাড়িয়ে গেলে উক্ত ঘটনা ঘটবার সম্ভাব্যতা কার্যত শূন্য।     

বিখ্যাত পদার্থবিদ স্যার ফ্রেড হয়েল (Sir Fred Hoyle) পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রকারান্তরে এ-প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি তার গ্রন্থ The Intelligent Universe-এ লিখেছেন: “একটা টর্নেডোর ধাক্কায় হঠাৎ করে প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ একত্রিত হয়ে একটি বোয়িং-৭৪৭ তৈরি হয়ে যাবার সম্ভাবনা যতোটুকু, দৈবক্রমে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির সম্ভাবনাও ততটুকু।” [2]      

আমরা জানি, একটি স্বত:বিভাজনশীল কোষের ভেতর ডিএনএ, আরএনএ ও প্রোটিন কমপ্লেক্স থাকতে হবে। চিন্তার সুবিধার্তে ধরে নেই যে পৃথিবীর আদিম পরিবেশে প্রোটিন বা ডিএনএ বা আরএনএ-আগে এসেছে । এরপর ধাপে ধাপে কোষ তৈরি হয়েছে (যা আসলে সম্ভব কিনা আলোচনা সাপেক্ষ)।     

এবার, উপর্যুক্ত সম্ভাবত্যার সীমার কথা মাথায় রেখে আসুন দেখি আদিম পরিবেশে প্রোটিন বা ডিএনএ বা আরএনএ তৈরি হওয়া সম্ভব কি না।

প্রোটিন (তথা এনজাইম) সৃষ্টি  

একটু বিশ্লেষণে যাচ্ছি! প্রাণিদেহের অন্যতম নিয়ামক কোষ। কোষ সম্পর্কে প্রথম সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় ১৯৩৯ সালেজার্মান প্রাণিবিদ থিওডোর স্বোয়ানের কাছ থেকে। এর আগে কোষের সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। প্রতিটি কোষের মূল উপাদান হচ্ছে প্রোটিন ( Protein )। প্রোটিন হচ্ছে কোষের প্রোটোপ্লাজমের মূল উপাদান এবং সকল উদ্ভিদও প্রাণী দেহে এটি ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। আবার প্রোটিন হল অসংখ্য অ্যামিনো এসিডের সমন্বয়ে গঠিত বৃহদাকার যৌগিক জৈব অনু।এই অ্যামিনো অ্যাসিড গুলি প্রোটিনের ভিতরে শুধু পেপটাইড নামক এক প্রকার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। একটি অ্যামিনো এসিডের কার্বোক্সিল মূলক (COOH-) অপর একটি অ্যামিনো এসিডের অ্যামিনো গ্রুপের সাথে (NH) যে বন্ধনে যুক্ত থাকে তাকে পেপটাইড বন্ধন বলে। কোষের বাইরে এই অ্যামিনো অ্যাসিড গুলি আরো অনেক বন্ধনে যুক্ত হয় কিন্তু কোষের ভিতর এই অ্যামিনো অ্যাসিড গুলি শুধু মাত্র পেপটাইড বন্ধনেই আবদ্ধ থাকে। প্রোটিন গঠনকারী এই অ্যামিনো এসিডের রয়েছে ২০টি প্রকারভেদ। এই ২০ প্রকারের অ্যামিনো অ্যাসিড নিজেদের ভিতর সঠিক ক্রমানুসারে সজ্জিত হতে হবে। একটি সাধারণ আকারের প্রোটিন কম পক্ষে ৫০০ টি অ্যামিনো এসিডের সমন্বয়ে গঠিত হয়। তবে সবচেয়ে অবাক করা জিনিস হল এই অ্যামিনো অ্যাসিড গুলি আবার ডান হাতি ও বাম হাতি হয়। প্রোটিন গঠনে শুধু মাত্র বামহাতি অ্যামিনো অ্যাসিড গুলি যুক্ত থাকে। প্রোটিন কাঠামোর মাঝে যদি একটিও ডান হাতি অ্যামিনো এসিডের প্রবেশ ঘটে তবে এই প্রোটিন কাঠামোটি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটি অকার্যকর খণ্ডে পরিণত হবে। এখন আমরা একটি প্রাণী কোষের মূল উপাদান প্রোটিনের যে মূল বৈশিষ্ট্য গুলি পেলাম তা হল প্রোটিনের মাঝে অ্যামিনো অ্যাসিড গুলি শুধু মাত্র পেপটাইড বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ থাকে, প্রোটিন সমূহের সংগঠনে ব্যবহৃত ২০ টি বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিড গুলি শুধু মাত্র বাম হাতিহতে হবে, এখন ডারউইনের মতে কাঁকতলিয় ভাবে যদি প্রাণের উৎপত্তি হয়ে থাকে তাহলে সামান্য ৫০০ অ্যামিনো এসিডের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রোটিন অনু গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা পরিসংখ্যানের Probability অনুসারে দাঁড়ায় যথাক্রমে:

১. সঠিক ক্রমানুসারে অবস্থানের সম্ভাবনা = ১/২০^৫০০= ১/১০^৬৫০ (যেহেতু Log { (20)^500}=500 Log20=650 এবং Log { (10)^650}= 650log10=650)  

২. সবগুলি বাম হাতি হওয়ার সম্ভাবনা = ১/২^৫০০= ১/১০^১৫০ (পূর্বের নিয়মে লগারিদম করে)  

৩. পেপটাইড বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা= ১/২^৪৯৯= ১/১০^১৫০ (পূর্বের নিয়মে লগারিদম করে] সর্ব মোট সম্ভাবনা= ১/১০^৯৫০ অর্থাৎ ১০^৯৫০ ভাগের একভাগ)   

এখন দেখা যাচ্ছে ৫০০ অ্যামিনো এসিডের সমন্বয়ে গঠিত একটি সাধারণ প্রোটিন মলিকুল কাঁকতলিয় ভাবে গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ১ সংখ্যাটির পরে একটানা ৯৫০ টি শূন্য বসালে যেসংখ্যাটি দাঁড়ায় সেই সংখ্যাটি দ্বারা ১ সংখ্যাটি ভাগ করলে যে ভাগফল দাঁড়াবে, ঠিক ততভাগের একভাগ অর্থাৎ মোট সম্ভবনা ১/১০^৯৫০। বুঝতেই পারছেন এটা নিতান্তই কাগুজে সম্ভাবনা বা Probability on paper. বাস্তবে এটি ০ সম্ভাবনারই নামান্তর। পরিসংখ্যান এর নিয়ম অনুযায়ী ১০^৫০ ভাগের এক ভাগ সম্ভাবনাকে শূন্য সম্ভাবনা হিসাবেই ধরা হয়। এই যদি হয় সামান্য একটি প্রোটিন গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা তাহলে ১ মিলিয়ন প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের দেহ কাঁকতলিয় ভাবে গঠন হওয়া কতটা সম্ভব আপনারা একটু চিন্তা করেন!! আর এই ভাবে যদি কখনো একটি প্রোটিন গঠিত হয় তাহলে এই সময় লাগবে বিগব্যাং সংগঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যত সময় লেগেছে ততদিন।  

ডগলাস এক্স যে বিষয়গুলো সম্ভাব্যতা কমাতে পারে সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে (অর্থাৎ বাদ দিয়ে) ১৫০টি  অ্যামাইনো এসিডের একটি প্রোটিন তৈরি দুর্ঘটনাক্রমে হওয়ার সম্ভাব্যতা হিসেব করেছেন ১০ এর পরে ১৬৪টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটি হয় (তথা ১০১৬৪) এর মধ্যে ১ বার অর্থাৎ ১/১০^168। মাত্র ১৫০টি অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে নির্মিত একটি মাঝারি সাইজের সুনির্দিষ্ট প্রোটিন আসাও গাণিতিকভাবে অসম্ভব একটি ব্যাপার কারণ এটা আসার সম্ভাব্যতা ১০^১৬৪। [3] 

বিল ডেম্ব্সকি হিসেব করে দেখিয়েছেন আমাদের দর্শনযোগ্য মহাবিশ্বে ১০৮০টি এলিমেন্টারি পার্টিকল আছে, বিগব্যাং থেকে এখন পর্যন্ত ১০১৬ সেকেন্ড পার হয়েছে এবং দুটো বস্তুর মধ্যে যে কোন বিক্রিয়া প্ল্যাঙ্কটাইম ১০-৪৩ সেকেন্ড এর চেয়ে কম সময়ে হতে পারে না। এ সবগুলো সংখ্যাকে একত্রিত করলে দাঁড়ায় ১০১৩৯;  অর্থাৎ মহাবিশ্বের বয়স, মহাবিশ্বের গাঠনিক এলিমেন্টারি পার্টিকেলের  সংখ্যা এবং পার্টিকেলের মধ্যে বিক্রিয়া হতে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সময়কে  একত্রে বিবেচনার পরও উপর্যুক্ত প্রোটিনটি তৈরি হওয়ার সম্ভাব্যতা ট্রিলিয়ন  ভাগ পিছিয়ে পড়ে। সহজ কথায় উক্ত প্রোটিনটি তৈরি হতে এখন বিলিয়ন  ট্রিলিয়ন সেকেন্ড (১০২৫বা ১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ বা দশ লক্ষ কোটি কোটি সেকেন্ড বা একত্রিশ কোটি বিলিয়ন বছর) অতিবাহিত হতে হবে। [4]  

শুধু একটি নিউ প্রোটিন ফর্মের জন্য অনেক ইনফরমেশনের দরকার হয়। তার উপর কোনটা কীভাবে অ্যাডজাস্ট করলে প্রোটিন কোনটা ফাংশন করবে কোনটা করবে না তারও একটা ফ্যাক্টর আছে। শুধু মাত্র একটি ফাংশনাল শর্ট প্রোটিন যদি মিউটেশনের মাধ্যমে আনতে চান তাহলে সেটার প্রবাবিলিটি হচ্ছে 10^74 এর মধ্যে একটি। মানে একটা শুধু একটি চান্স থাকে ১০০ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন...ট্রিলিয়নের মধ্যে। [5]

যে কোন র‍্যান্ডম ঘটনা এই সীমাকে ছাড়িয়ে গেলে আমাদের মহাবিশ্বে তা ঘটার সম্ভাবনা নেই। একটি মাঝারি সাইজের প্রোটিনের এই অবস্থা। অথচ, আরএনএ পলিমারেজ এনজাইম ১০০০-এর বেশী অ্যামাইনো অ্যাসিড যুক্ত তিনটি প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, আরএনএ-র কপি তৈরির জন্য আরএনএ পলিমারেজ এনজাইম লাগবে এবং আরএনএ-র জন্য সুনির্দিষ্ট পরিমাণে নিউক্লিউকিওটাইড-এর জোগান সুনির্দিষ্ট তরল মাধ্যমে থাকতে হবে। আর আমি এখানে শুধু প্রোটিনের কথাই বললাম, মাইটোকন্ড্রিয়া, সাইটোপ্লাজম, রাইবোজোম, প্লাজমা ঝিল্লি, ফ্লাজেলা, পিলি, জিনোম (ডিএনএ), ক্রোমোসোম, কোষ প্রাচীর, পিগমেন্ট, প্লাজমিড, ভলিউটিন ইত্যাদি গঠন হওয়া যে কেমন হবে তা আপনারা নিজেরাই বুঝে নিন। এখন তাহলে প্রশ্ন আসে প্রাণের উৎপত্তি তাহলে কীভাবে হয়েছে? হঠাৎ করে?

"কীভাবে অজীবন্ত অণু জীবিত অণুতে পরিণত হল, এবং অজৈব কীভাবে জৈব হল? কীভাবে রসায়ন জীববিজ্ঞানের জন্ম দেয়?" এই প্রশ্নগুলোর জবাবে `What is life? How chemistry becomes biology‘ বইটির লেখক Addy pross বলেন, "আমরা প্রায় নিশ্চিতভাবেই কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাবনা।" 

স্লাইডেন এবং সোয়ান যারা কোষ তত্ত্বের প্রবর্তক তাঁরা বলেছেন ”Every cell comes from a pre-existing cell” প্রত্যেকটি কোষ শূন্য থেকে আসে না। তার অবশ্যই একটি মাতৃকোষ থাকে। ডারউইনের বিবর্তবাদ এটির ব্যাখ্যা দিতে পারে না যা কীভাবে জীবনের উৎপত্তি হল। 

DNA ও RNA এর আত্মকাহিনি, কে আগে আসবে?

ডিএনএ থেকে তথ্য পড়বে কে? যদি ডিএনএ অণু এমন কোন গঠন তৈরি করতে সক্ষম হত যা এনজাইমের মত কাজ করে তাহলেও চিন্তা করার সুযোগ থাকতো। কিন্তু, আমরা জানি, ডিএনএ বৈচিত্র্যপূর্ণ গঠন তৈরি করতে পারে না। অর্থাৎ ডিএনএ কোন ক্রিয়াশীল এনজাইম বা স্ট্রাকচারাল প্রোটিনের মত গাঠনিক বৈচিত্র্য তৈরি করতে অক্ষম। সুতরাং বাকী রইল আরএনএ। আরএনএ কি কেমিকেল এভল্যুশন তথা এবায়োজেনেসিসকে উদ্ধার করতে পারবে?

বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরীতে এমন এক ধরনের আরএনএ সংশ্লেষ করতে পেরেছেন যা নিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট পরিবেশে এনজাইম হিসেবে কাজ কোরে আরএনএ পলিমারাইজেশনেকে (অর্থাৎ আরএনএ থেকে আরএনএ তৈরি হওয়া-কে) প্রভাবিত করতে পারে। অর্থাৎ, একটি সম্পূরক আরএনএ টেমপ্লেট-এর বিপরীতে নিউক্লিওটাইড (A এর বিপরীতে U, U এর বিপরীতে A, G এর বিপরীতে C, এবং C এর বিপরীতে G) যোগ করার মাধ্যমে নিজের একটি কপি তৈরি করতে পারে। এই বিশেষ ধরনের আরএনএকে বলে রাইবোজাইম। এর মাধ্যমে তারা বলতে চাচ্ছেন যে, আদিম পরিবেশে এ ধরনের একটি রাইবোজম আসার মাধ্যমে সেল্ফ-রেপ্লিকেশনের সূচনা হয়েছে এবং পরবর্তীতে ‘কোন একটি উপায়ে’ কোষের অন্যান্য গঠনগুলোর (তথা ডিএনএ, ও বিভিন্ন  প্রোটিন, ফসফোলিপিড, গ্লাইকোক্যালিক্স) আবির্ভাব হয়েছে! যে কোন ব্যক্তি একটু মাথা খাটালেই বুঝবে এ ধরনের চিন্তা কতখানি অ্যাবসার্ড! কিন্তু কেন?

এক, পৃথিবীর আদিম পরিবেশ ল্যাবরেটরির মত নিয়ন্ত্রিত ছিল না। 

দুই, ‘রাইবোজাইম নিজের একটি কপি তৈরি করতে পারে’ এই অবস্থা থেকে ‘আরএনএ প্রোটিনের তথ্য ধারণ করে এবং তা প্রোটিন সংশ্লেষ করে’ এই অবস্থায় যাওয়ার কোন পথ নেই। কারণ, উপরে আমরা ডিএনএ-র ক্ষেত্রে যে রকম বলেছি ঠিক তেমনি কোন কোডনটি কোন অ্যামাইনো এসিডের জন্য নির্ধারিত হবে সেটি নির্বাচন করা একটি বুদ্ধিমান ‘মাইন্ড’-এর কাজ। তদুপরি, যদি অপটিমাম ইউনিভার্সাল কোডনের জন্য র‍্যান্ডম অনুসন্ধান করা সম্ভবও হতো, সেক্ষেত্রে প্রতি সেকেন্ডে ১০^৫৫টি অনুসন্ধান চালাতে হতো। কিন্তু, বায়োফিজিসিস্ট হার্বাট ইওকি হিসেব করে দেখিয়েছেন র‍্যান্ডম অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় ১.৪০ x ১০^৭০টি সম্ভাব্য কোডনের মধ্যে উক্ত অপটিমাম কোডন সিস্টেমকে খুঁজে বের করতে হবে এবং হাতে সময় পাওয়া যাবে ৬.৩ x ১০^১৫ সেকেন্ড। [6] এছাড়াও, রাইবোজোমে যে প্রোটিন সিনথেসিস হয় তাতে অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট প্রোটিন ও আর-আরএনএ-র নির্দিষ্ট অবস্থানগত ও তড়িৎ-রাসায়নিক ভূমিকা আছে। অথচ, আরএনএ প্রোটিনগুলোর মত বিভিন্ন ধরনের স্ট্রাকচার গঠন করতে পারে না। কারণ, আরএনএ-র নিওক্লিটাইডের ধরণ সংখ্যা সীমিত এবং তাদের কেমিক্যাল স্ট্রাকচারও অ্যামাইনো এসিডের ন্যায় বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়।

তিন, রাইবোজাইম নিজের কপি করতে পারে তখনই যখন তার সম্পূরক একটি টেমপ্লেট থাকে। অর্থাৎ, আদিম পরিবেশে সেল্ফ রেপ্লিকেটিং রাইবোজাইম আসতে হলে রাইবোজাইম ও তার সম্পূরক টেমপ্লেট দুটো অণুরই একসাথে আসতে হবে। জনসন ও তার সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে, আংশিকভাবে নিজের কপি তৈরি করতে পারে এরকম একটি রাইবোজাইমের নিউক্লিওটাইডের সংখ্যা ১৮৯। সুতরাং, উক্ত স্পেসিফিক রাইবোজাইম এবং তৎসংশ্লিষ্ট সম্পূরক ও সুনির্দিষ্ট টেমপ্লেট-এর একসাথে আসার সম্ভাব্যতা ৪^১৮৯ x ৪^১৮৯ তথা ৪^(১৮৯+১৮৯=৩৭৮) তথা প্রায় ১০^২৭৭, যা বিশ্বজনীন সম্ভাব্যতার সীমা ১০^১৪০ কে ছাড়িয়ে যায় (অর্থাৎ, অসম্ভব)। অথচ, পুরোপুরি কপি করতে পারে এরকম একটি রাইবোজাইমে নিউক্লিওটাইড সংখ্যা লাগবে আরও বেশী।  অন্যদিকে, অর্গেল ও জয়েস দেখিয়েছেন যে, এরকম দুটি আরএনএ খুঁজে পাওয়ার জন্য ১০^৪৮ টি অণু খুঁজতে হবে যা পৃথিবীর মোট ভরকে অতিক্রম করে যায়। [7] অর্থাৎ, আমরা দেখতে পেলাম আরএনএ এ বায়োজেনেসিসকে উদ্ধার করতে কোন অবস্থাতেই সক্ষম নয়।

শুধুমাত্র একটা প্রোটিন বা আরএনএ আসতে যদি এত হার্ডেল পার হতে হয়। আপনারা একবার অনুমান করে দেখুনতো অসংখ্য সুনির্দিষ্ট মাত্রা ও গঠনের ডিএনএ, আরএনএ, প্রোটিন, ফসফোলিপিড, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল কম্পোজিশন সহ আন্ত:কোষ তরল সমেত কোষ দৈবাৎ আসা কি আদৌ সম্ভব?

DNA হচ্ছে জীবনের রাসায়নিক ভিত্তি। এ DNA এর উপাদান ৫টি কার্বন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও ফসফরাস। DNA গুলো অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করে আর এই অ্যামিনো এসিডগুলো প্রোটিন তৈরি করে। আজকের বিজ্ঞান আমাদের বলে একটি DNA অনু যদি হঠাৎ করে তৈরি হত, অর্থাৎ, ধরুন, একটি পাত্রে কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H), নাইট্রোজেন (N) অক্সিজেন (O), ফসফরাস (P) ইত্যাদি মৌলসমূহ রয়েছে; পত্রটিতে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ও চাপ উভয়ই বিদ্যমান; এমতাবস্থায়, এ সকল মৌলসমূহ নিজেরা বিক্রিয়া করে একটা DNA অণু তৈরির সম্ভাবনা 1/10^268 …………….……………….0000000000000000000001 যা শূন্যের কাছাকাছি। এমনকি বিশ্ব জগতের সব অণু-পরমাণু একত্রিত করেও একটি DNA তৈরি করা সম্ভব না। এতো গেলো ডারউইনিজম প্রস্তাবিত অসম্ভব উপায়ে DNA তৈরির সম্ভাবনা; সেই DNA থেকে একটা নিউক্লিয়াস, অতঃপর, তা থেকে একটা কোষ!— এগুলো তো অসম্ভবের উপর আরো বড় অসম্ভব! আলোচনার খাতিরে যদি ধরেই নেই, এমন অসম্ভবও কোনোভাবে সম্ভব হয়েছিল; কিন্তু, DNA একটা জড় অণু মাত্র! আরা কোষসমূহ জীবিত, যাতে প্রাণ আছে! তাহলে জড় DNA অণু থেকে জীবন্ত কোষ হওয়া কীভাবে সম্ভব হল?  

সম্ভবনা গুলো যদি সম্ভব হয়ও তারপরও আরো কিছু সমস্যা থেকেই যায়। প্রাণতত্ত্ববিদদের অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে যে, কীভাবে অ্যামিনো অ্যাসিড বা অন্যান্য মূল-জৈব অণুগুলি দীর্ঘ শিকলের (পলিমার) গঠন করে প্রোটিন (বা RNA) তৈরি করে। কারন পুরো বিক্রিয়া যেহেতু পানির ভিতরে হচ্ছে, আমাদের দেখতে হবে যে, পানির ভেতরে অ্যামিনো এসিড কোন শিকলে যুক্ত হতে পারে কিনা। যেমন ন্যাশনাল একাডেমি অব সাইন্সের মতে, “দুটি অ্যামিনো অ্যাসিড স্বতঃস্ফূর্তভাবে জলীয় পরিবেশে পরস্পর যুক্ত হয় না। বরং, বিপরীত বিক্রিয়া তাপগতিবিদ্যা অনুযায়ী অনুকূলে থাকে”[8]  

অন্যকথায়, পানি প্রোটিন অনুকে ভেঙে ফেলে, তাই উক্ত পরিবেশে প্রোটিন তৈরি হতে পারে না। আরও আগে, স্ট্যানলি মিলার দেখিয়েছিলেন যে, ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় অ্যাডেনিন ও গুয়ানিনের অর্ধায়ু প্রায় এক বছর, ইউরাসিলের ১২ বছর, এবং সাইটোসিনের ১৯ দিন। [9] সাধারণত ভেন্ট [ফাটলের] তাপমাত্রা ৩৫০ ডিগ্রি [সমুদ্রের তলদেশে উচ্চচাপে পানির স্ফুটনাঙ্ক ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস] সেলসিয়াস হতে পারে। মিলারের গবেষণা অনুযায়ী, উক্ত তাপমাত্রায় অ্যামিনো এসিডের অর্ধায়ু কয়েক মিনিট, ৪৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সুগারের অর্ধায়ু সেকেন্ডের এককে নেমে আসে। আর ডিএনএ/আরএনএ তৈরির জন্য সুগারের বন্ধন হওয়া জরুরি। পলিপেপটাইডের অর্ধায়ু কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে উঠা-নামা করে। আরএনএ ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে জলবিশ্লেষিত হয়ে যায়, এবং ৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে মাত্র কিছু সেকেন্ড টিকে থাকে। মিলারের মতে, একই ভেন্ট নিউক্লিওটাইড ধ্বংসের জন্য দায়ী। [10] অনেক জটিল অ্যামিনো এসিড যেমন- সেরিন ও থ্রিওনিন তাপ প্রয়োগে নষ্ট হয়ে যায়। [11]  

আরেকটি সমস্যা হল, অ্যামোনিয়া তৈরি, কারন প্রাণসৃষ্টির জন্য অ্যামোনিয়া খুব জরুরি। আর আদিম পৃথিবীতে অ্যামোনিয়া যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না। তবে রসায়নের মূলনীতি অনুযায়ী, অ্যামোনিয়া তৈরির জন্য নাইট্রোজেনকে হাইড্রোজেন সালফাইড বা আয়রন সালফাইডের বিক্রিয়াপথে পরিচালিত করতে হবে। গবেষণাগারের তথ্যানুযায়ী, হাইড্রোজেন সালফাইড পথ খুব সামান্য পরিমাণ অ্যামোনিয়া প্রস্তুত করে, যা প্রাণ সঞ্চারের জন্য যথেষ্ট নয়। আর আয়রন সালফাইড বিক্রিয়াপথ খুব ধীর গতির। [12]  

মিলার দেখিয়েছেন যে, আজকের জলতাপীয় ফাটলগুলোর ঘনত্ব এমন যে, মহাসাগরগুলোর সমস্ত পানি ১০ মিলিয়ন বছর লম্বা চক্রের মধ্যে পরিচলন পদ্ধতিতে চলাচল করে। আজ থেকে ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে, জলতাপীয় ফাটলের ঘনত্ব আরও অনেক বেশি ছিল। অন্যকথায়, পানির চলাচলের সময় অনেক কম ছিল। যদি কোনোভাবে প্রাণ প্রয়োজনীয় অনু তৈরি হয়েও থাকে, তা মহাসাগরের ফাটল পেরিয়ে বিক্রিয়াস্থল থেকে দূর সাগরে হারিয়ে যেত।  

কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া উন্নত সফটওয়্যার প্রোগ্রাম ‘ডিএনএ’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রতিটি কাজ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে খুব জটিল যন্ত্রাংশে সম্পাদিত হয়। তাহলে সমুদ্রের অনিয়ন্ত্রিত বিক্রিয়াকে কীভাবে ATP তৈরির সাথে তুলনা করা যায়? প্রাণীর জন্য ২০ প্রকারের অ্যামিনো অ্যাসিড দরকার। অন্য সকল অ্যামিনো অ্যাসিড প্রাণের কোন কাজে আসে না। আমাদের ডিএনএতে প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য কোড করা আছে। হাইড্রো-থার্মাল ভেন্টে ডিএনএ/আরএনএ ছিল না। আর প্রাকৃতিকভাবে ডিএনএ বা আরএনএ অদ্যাবধি উৎপন্ন হতে দেখা যায় নি, কিংবা তা উৎপাদন করার জন্য প্রয়োজনীয় ‘তথ্য’ প্রকৃতি সরবরাহ করতে পারে না। প্রফেসর পল ডেভিস বলেন, “...প্রথম কোষকে জীবন্ত করে তুলতে অদ্ভুত গঠনের তথ্য কোথা থেকে আসলো? কেউ জানে না...” [13] “কোন প্রাকৃতিক আইন [ডিএনএ তৈরির] তথ্য সরবরাহ করতে পারে না” [14] 

এতক্ষণে অবশ্যই বুঝতে পেড়েছেন প্রাণের উৎপত্তি কত জটিল বিষয়। প্রশ্ন হচ্ছে সামান্য এক কোষী প্রাণের সৃষ্টি যদি এতটা জটিল ও প্রায় অসম্ভব হয় তবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর সৃষ্টির জটিলতা কি আমরা কল্পনা করতে পাড়ি? চিন্তা করে দেখুন শুধু একটা কাজ কাকতালীয় ভাবে নিজ থেকে হতে সম্ভাবনার এত বড় অঙ্ক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, সেখানে সবকিছু হতে প্রতি ক্ষেত্রে কত বেশি ভয়ংকর রকমের সম্ভাবনার অঙ্ক দাঁড়িয়ে যাবে! চিন্তা করে দেখুন সব কিছু প্রতি বার কাকতালীয় ভাবে সঠিক প্রক্রিয়ায় হওয়া সম্ভব? 

২০টি বেশ কয়েক ধরনের কালার ও দামের চকোলেটের প্যাকেট এক সাথে হাতে নিয়ে টেবিলের উপর ছুড়ে মারুন ও চেষ্টা করবেন যে যাতে সেগুলা  ‍ছুড়ে মারার পর সেগুলা সমান একটি লাইনে যেয়ে এক সাথে সমান্তরাল ভাবে অবস্থান করে ও একই রঙ্গের গুলো যাতে এক সাথে থাকে ও মূল্যের ক্রমানুসারে অবস্থান করে। কয়েক বিলিয়নবার চেষ্টা করে দেখুন সম্ভব হয় কিনা। তারপর নিজেই চিন্তা করুন শুধুমাত্র একটি এককোষী জীব নিজ থেকে তৈরি হতে যতগুলো প্রক্রিয়ার যত স্টেপে যত সম্ভবনা রয়েছে সেগুলোর এত বড় বড় সম্ভাবনাকে কি করে নিজে থেকেই এত সহবে কমপ্লিট করতে পারে! 

অথচ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান স্রষ্টা, তার কাছে এগুলা কোন জটিল বিষয় না।  আরে মানুষের সেই ক্ষমতা নেই যে একটি শুক্রাণু তৈরি করে সেটাকে মানুষ বানাবে। পাঠককে বলছি আপনি জানেন কি আপনার জন্মের সম্ভাব্যতা কত ছিল! মানুষ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছ উৎপাদন করে, যেমন একটি পদ্ধতি হল টিস্যু কালচার। একটি উদ্ভিদ তৈরি করতেও মানুষকে প্রকৃতির উপর নির্ভর করতে হয়, তাও নতুন উদ্ভিদ তৈরি করতেও একটি মাতৃউদ্ভিদ থাকা বাধ্যতা মূলক। কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন -

তোমরা ভেবে দেখেছ তোমাদের বীর্যপাত সম্বন্ধে? সেটা কি তোমরা সৃষ্টি কর, না আমরা সৃষ্টি করি? তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কে চিন্তা করেছ কি? তোমরা কি সেটাকে অংকুরিত কর, না আমরা অংকুরিত করি? তোমরা যে পানি পান কর তা সম্পর্কে আমাকে জানাও, তোমরা যে আগুন জ্বালাও সে ব্যাপারে আমাকে বল, তোমরাই কি এর গাছ সৃষ্টি কর, না আমরা সৃষ্টি করি? (সূরা ওয়াকিয়াহ আয়াত ৫৮,৫৯, ৬৩,৬৪,৬৮,৭১,৭২) 

অনেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া দেখিয়ে বলে এভাবে, সেভাবে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন নাস্তিকদের বা বিজ্ঞানীদের অনেকে বলে থাকে যে, “পৃথিবীতে যখন তাপমাত্রা কমে 1000 ডিগ্রি সেলসিয়াস তখন বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন অজৈব অণু যেমন হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া , মিথেন ,জলীয় বাষ্প, কার্বন-ডাই-অক্সাইড , ইত্যাদির সঙ্গে আকাশের বজ্র বিদ্যুৎ যা তড়িৎ শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ও অতিবেগুনি রশ্মি ইত্যাদি মিলিত প্রক্রিয়ায় সমুদ্র লাভা মিশ্রিত গরম জলে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে সম্ভব হয়েছিল ও এর থেকেই সরল জৈব অণু যেমন অ্যামাইনো অ্যাসিড ,ফ্যাটি অ্যাসিড ও পরে তৈরি হয় জটিল জৈব অণু যেমন অ্যাসিড, নিউক্লিক অ্যাসিড যা ডিএনএ ও আরএনএ তৈরি করতে সক্ষম, এভাবেই সমুদ্রের জলে কোষ সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে ওঠার পর সৃষ্টি হয় আদিকোষ বা প্রোটোসেল যা থেকে পরে ব্যাকটেরিয়া বা এককোষী জীব সৃষ্টি হয়, প্রায় দু বিলিয়ন বছর আগে সায়ানোব্যাকটেরিয়ার মত কিছু ব্যাকটেরিয়া যা অক্সিজেন তৈরি করতে সক্ষম ছিল তাদের জন্ম হয় পৃথিবীতে ও তাদের জন্য পৃথিবীতে মুক্ত অক্সিজেন এর আবির্ভাব ঘটল ও মুক্ত অক্সিজেন এর ফলে শ্বসন যুক্ত জীব কোষের সৃষ্টি হয় ও জীবের সৃষ্টি হয়।”   

এখানে যা কিছু বলা হয়েছে সবকিছুই শুধু ধারণা কারণ এই মতবাদের পক্ষে কোন শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই। এবং কাকতালীয় ভাবে প্রাণ সৃষ্টি যে একপ্রকার অসম্ভব তা আমি আগেই প্রমাণ করেছি। যদি প্রাণ সৃষ্টি এতই সহজ হত তাহলে বর্তমানে কেউ সেই প্রক্রিয়ায় কোন জীব সৃষ্টি করছে না কেন? প্রাণী ও উদ্ভিদকোষত অনেক দূরের কথা শুধু একটি আদিকোষী জীব সৃষ্টি করাই কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি আজ পর্যন্ত, যদি তৈরি করেও ফেলে তাহলেও সেটাকে কৃত্রিমভাবে এককোষী জীবের মত হুবহু বৈশিষ্ট্য ও নিজস্বতা দেওয়া মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

মানুষ কৃত্রিম প্রাণ সৃষ্টি করেছে!!

কিছু নাস্তিক একটি নিউজ অনেক বেশি ছড়াচ্ছে সেটা হল, ‘কৃত্রিম জীবন্ত কোষ সৃষ্টিতে সাফল্য পেলেন বিজ্ঞানীরা।’ এরকম আরো কয়েকটা আর্টিক্যালের টাইটেল দেখেই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম, যখন সেটা নিয়ে সব তথ্য বের করি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম নাস্তিকদের অজ্ঞতা বা মিথ্যাচার সম্পর্কে অথচ বিজ্ঞানীরা কোষ সৃষ্টিই করেনি বাস্তবে কারণ সৃষ্টি করা মানে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনা। বিজ্ঞানীরা কেবল পরিবেশ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে জেনেটিক সফটওয়্যার তৈরি করেন এবং সেটি অন্য এক ব্যাকটেরিয়ার কোষে প্রতিস্থাপন করেন৷ যা পরে একে একে এই জিনোম একটি থেকে আরেকটি ব্যাকটেরিয়ায় প্রতিস্থাপিত করা হয়৷ গবেষকরা এই প্রক্রিয়াকে একটি নতুন কৃত্রিম কোষ বলে অভিহিত করছেন। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন -

হে মানুষ, একটি উপমা পেশ করা হল, মনোযোগ দিয়ে তা শোন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয়, তারা তার কাছ থেকে তাও উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও যার কাছে অন্বেষণ করা হয় উভয়েই দুর্বল। [সূরা হজ্জ আয়াত ৭৩]

মাইকোপ্লাজমা জেনিটালিয়ামে পৃথিবীর যেকোন মুক্ত-জীবিত জীবের ক্ষুদ্রতম জিনোমগুলির মধ্যে একটি রয়েছে, যা মাত্র 525টি জিন রয়েছে। এটি E. coli এর মতো অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার আকারের একটি ভগ্নাংশ, যার 4,288 টি জিন রয়েছে। এম. জেনিটালিয়ামের ক্ষীণ জিনোম এটিকে স্ট্যানফোর্ড এবং জে. ক্রেগ ভেন্টার ইনস্টিটিউটের গবেষকদের জন্য প্রথম লক্ষ্য বানিয়েছে যারা সফ্টওয়্যারে একটি জীবকে অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন।  

স্ট্যানফোর্ডের মার্কাস কভার্টের নেতৃত্বে জৈব প্রকৌশলীরা ব্যাকটেরিয়াটির মডেলিং করতে সফল হন এবং কিছু দিন আগে তাদের কাজটি সেল জার্নালে প্রকাশ করেন। চিত্তাকর্ষক বিষয় হল এই সাধারণ জীবটিকে আংশিকভাবে অনুকরণ করতে তাদের কত অশ্বশক্তি প্রয়োজন। দেখা যায় ১২৮টি কম্পিউটারের একটি গুচ্ছ কাজ করেছে ৯ থেকে ১০ ঘন্টা যাবত কোষের জীবনচক্র প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ২৫ ধরনের অণুর তথ্য তৈরি করতে।   

আবার সেলুলার জটিলতার গভীরতা এবং প্রশস্ততা প্রায় অবিশ্বাস্য, এবং পরিচালনা করা অনেক কঠিন, এমনকি মোরের ল অনুসারেও। এম. জেনিটালিয়াম মডেলের জন্য ২৮টি সাবসিস্টেমকে পৃথকভাবে মডেল করা এবং একীভূত করা প্রয়োজন, এবং কাজের অনেক সমালোচক অভিযোগ করেছেন যে সিমুলেশনটিকে বাস্তবসম্মত কিনা তা বিবেচনা করার প্রয়োজন কারন শেষ পর্যন্ত যা যা প্রয়োজন হবে তার মাত্র একটি ভগ্নাংশ এটি।   

"এই মুহুর্তে, একটি একক সেল শুধু একবার বিভক্ত করতে একটি সিমুলেশন চালানো হলে তার জন্য প্রায় ১০ ঘন্টা সময় লাগে এবং অর্ধেক গিগাবাইট ডেটা তৈরি করে," এটি সেখানের প্রধান বিজ্ঞানীদের একজন কভার্ট নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন। তিনি আরো বলেন, "আমি এই ফ্যাক্টটিকে সম্পূর্ণ আকর্ষণীয় বলে মনে করি, কারণ আমি জানি না যে কেউ কখনও জিজ্ঞাসা করেছে কিনা যে একটি জীবন্ত জিনিস সত্যিই কতটা ডেটা ধারন করে রাখে।"  

কৃত্রিম প্রাণ উদ্ভাবনের নেতৃত্ব দানকারী ড. ক্রেইগ ভেন্টর বলেছেন, “আমরা একে ‘শূন্য থেকে জীবন সৃষ্টি’ হিসেবে ভাবছি না বরং আমরা বিদ্যমান জীবন থেকেই নতুন জীবন সৃষ্টি করেছি সংশ্লেষিত ডিএনএ দ্বারা কোষগুলোকে নতুনভাবে প্রোগ্রাম করার মাধ্যমে। আমরা প্রোটিনও কৃত্রিমভাবে তৈরি করিনি, কোষও কৃত্রিমভাবে তৈরি করিনি এগুলো সবই ক্রোমোসোমের নির্দেশনা অনুসারে তৈরি হয়েছে।” তিনি আরো বলেছেন, “এটি মুক্তজীবি শুধু এই অর্থে যে এটি গবেষণাগারে সমৃদ্ধ কালচার মাধ্যমে জন্মাতে পারে, সুতরাং এটি বাইরের পরিবেশে জন্মাতে পারবেনা।” তিনি নিজের গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে বলেছে, “এক পর্যায়ে আমরা আবিষ্কার করলাম যে ১০ লক্ষ ডিএনএ বেস পেয়ারের মধ্যে মাত্র একটা ভুল থাকায় প্রাণ আসেনি!”   

একটি কোষ, একটি বিভাজন, অর্ধেক গিগাবাইট ডাটা। এখন অনুমান করুন যে একটি পিনের মাথায় লক্ষ লক্ষ ব্যাকটেরিয়া বসতে পারে  এবং তাদের অনেকগুলি এম. জেনিটালিয়ামের চেয়েও জটিল আকারের একটি ক্রমে বিন্যাস্ত। অথবা ধারণা চিন্তা করুন যে মানবদেহ ১০ ট্রিলিয়ন (বড়, জটিল) মানব কোষ এবং প্রায় ৯০ বা ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া কোষ দ্বারা গঠিত। এটি মোট প্রায় ১০০,০০০,০০০,০০০,০০০ কোষ।  

সময়ের বিখ্যাত আধুনিক নাস্তিকতার জনক নামে খ্যাত নাস্তিক এনথনি ফ্লিউ আস্তিক হওয়ার পর বলেছিলেন যে, “DNA ইনভেস্টিগেশন থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রাণ (Life) সৃষ্টিতে অবশ্যই অবশ্যই Intelligence তথা বুদ্ধিমান সত্ত্বার উপস্থিতি আবশ্যক।” There is a God এই বইটি তিনি এই কথা বলেছেন।

প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন উপাদান নিয়ে, বাস্তব ডিএনএ দেখে কপি পেস্ট করে কৃত্রিম ডিএনএ বা কৃত্রিম কোষ তৈরি করতে মানুষের নাজেহাল অবস্থা। আর এই ডিএনএ সহ প্রাণ নাকি আপনা আপনি চলে এসেছে!

তথ্যসূত্রঃ

[1] Abel DL. The universal plausibility metric (UPM) & principle (UPP). Theor Biol Med Model. 2009;6 (1):1–10.

[2] Nature, 12 November, 1981

[3] Meyer SC. Signature in the Cell. HarperCollins Publisher Inc. 2009; Page: 172

[4] Stephen C. Meyer, Signature in The Cell; পাভেল আহমেদ, বিবর্তনবাদ ও তার সমস্যা – ৭: সম্ভাবনার অসম্ভাব্যতা ২ বিবর্তনবাদ ও তার সমস্যা – ৮: সম্ভাবনার অসম্ভাব্যতা ৩ (ছক্কা বনাম প্রোটিন)

[5] Journal of Molecular Biology Volume 341, Issue 5, 27 August 2004, Pages 1295-1315

[6] Rana F. The Cell’s Design. Baker Books. 2009; Page: 175

[7] Stephen C. Meyer. Signature in the Cell. HaperCollins Publisher Inc. 2009; Page: 250

[8] Committee on the Limits of Organic Life in Planetary Systems, Committee on the Origins and Evolution of Life, National Research Council, The Limits of Organic Life in Planetary Systems, p. 60

[9] Levy, M and Miller, S.L., The stability of the RNA bases: Implications for the origin of life, Proc. Natl. Acad. Sci. USA 95(14):7933–38, 1998.

[10] Stanley L. Miller and Jeffrey L. Bada, “Submarine Hot Springs and the Origin of Life,” Nature 334 (1988): 609–11; Matthew Levy and Stanley L. Miller, “The Stability of the RNA Bases: Implications for the Origin of Life,” Proceedings of the National Academy of Sciences, USA 95 (1998): 7933–38.

[11] Gish, D.T., Origin of life: The Fox thermal model of the origin of life, Impact 33, Institute for Creation Research, March 1976.

[12] Martin A. A. Schoonen and Yong Xu, “Nitrogen Reduction under Hydrothermal Vent Conditions: Implications for the Prebiotic Synthesis of C-H-O-N Compounds,” Astrobiology 1 (2001): 133–42.

[13] Davies, P., Life Force, New Scientist, 1:27–30, 18 September 1999.

[14] Davies, P., The Fifth Miracle, Penguin Books, London, UK, p. 100, 1999.

[বিদ্রঃ লিখার রেফারেন্স গুলোর বেশিরভাগ Md. Abdullah Saeed Khan ও Mushfiqur Rahman Minar ও Rubyat Farzan ভাই সহ আরো কিছু ভাইদের লিখা হতে সংগ্রহ করা হয়েছে (অনেকের নাম কারণে-অকারণে উল্লেখ করতে পারিনি বিধায় আন্তরিক ভাবে দুঃখিত)]

Ashraful Nafiz

I am an ordinary Muslim student who is interested in acquiring the beneficial knowledge given by Allah and hopes to spread that knowledge among the people. facebook youtube twitter instagram quora

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Would you tell me something

নবীনতর পূর্বতন