এর আগে একটা আর্টিক্যালে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলেছিলাম, এই আরটিক্যালে ঐটারই বাকি অংশ তুলে ধরছি ও অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। চাইলে পড়ে আসতে পারেন আর্টিক্যালটির প্রথম অংশ
ঈশ্বর যে একজন সেটা কেন মানবেন?
ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম, ইহুদিধর্ম, বাহাই ধর্ম, জরাথ্রুস্ট্রবাদ, শৈব ধর্ম, শিখ ধর্ম, সনাতন ধর্ম (একত্ববাদ) প্রভৃতি হল একশ্বরবাদী ধর্ম, সাধারনত একঈশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে পরিচিত। সব ধর্মগ্রন্থের মূল একটা বিষয় হল স্রষ্টা শুধু একজন।
ইসলামে বলা হয়েছে স্রষ্টা একজন [সূরা ইখলাস] এছাড়া আল্লাহ কোরআনের বার বার বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতে বলেছেন আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়।
ইহুদী ধর্মে বলা হয়েছে তোমাদের ঈশ্বর একজন [দ্বিতীয় বিবরন ৪/৩৫-৩৯, ৬/৪-৫, ১৩/৪, ১৮/১৫, ৩২/৩৯; যীশাইয় ৬/৩, ৪০/১৮, ২৫, ২৮, ৪৩/১০-১১, ৪৪/৬-৭ ও ২৪, ৪৫/১২, ১৮, ৪৬/৯-১০, ৬৪/৪; হোসেয়া ১১/৯, ১৩/৪; গীতসংহিতা ৩৩/১১, ৮৩/১৮, ৮৬/৮ ও ১০, ৯০/২, ১১৩/৪-৫, ১৩৬/১-৩; আদি পুস্তক ১/১৭; গণনা পুস্তক ২৩/১৯; ইসাইয়া ৪৩/৩,১, ৪৪/৬, ৪৫/৫-৬, ২১-২৩, ৪৬/৯-১০; নেহেমিয়া ৯/৬; ডিওটোরনমি ৬/৪; যাত্রাপুস্তক ৮/১০, ২০/৪, ২২; বংশাবলী-১, ১৭/২০; ২ বংশাবলি ২/৫; ২ শ্যামুয়েল ৭/২২; ১ তীমথিয় ২/৫; ১ করিন্থীয় ৪/৬ ৮/৪-৬, ১২/৭-১১; রোমীয় ১/৭, ১০/১৩; ১ পিতর ১/২; গালাতীয় ৪/৮-৯, ৩/২০ ; মালাখি ২/১০, ৩/৬; হিতোপদেশ ১৯/২১; বিলাপ ৩/৩৭; এফিশীয় ৪/৬; হোশেয় ১১/৯, ১৩/৪; যোনাহ ১/৯, ২/৮,৯, মিখা ৪/৫, হবক্কুক ১/১২, ২/১৮, ১৯; ইয়োব ৪/১৭,১৮, ৯/৩২, ১৫/১৪-১৬; জাখারিয়া ১৩/৯, ১৪/৯; ইত্যাদি]
খ্রিষ্টান ধর্মে বলা হয়েছে তোমাদের ঈশ্বর একজন ও যিশু বার্তা বাহক [নিউ টেস্টামেন্ট, মার্ক ১০/১৭-২৭, ১২/২৮-৩২, ১৩/৩২, ১৪/৩৬; লুক ৪/৮, ৬/১২, ১০/২৫-২৮, ১৮/১৯, ২৪/১৯, ৩৯-৪২; যোহন ১/৩, ৪, ৩/১৬-১৭, ৪/১৯, ৫/৩৭, ৬/২৭, ১৪-১৮, ৭/১৬-১৭, ৯/১৭, ১০/২৯, ১৪/১৪, ২৮, ১৭/৩, ২০/১৭; মথি ৪/১০, ৫/১৭-১৮, ৬/৯, ৭/২১, ১৯/১৬-১৮, ২৩/৯-১০, ২৬/৩৯; ইত্যাদি],
হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে ঈশ্বর শুধু মাত্র একজন এবং তিনিই অন্য দেবতাদেরকে সৃষ্টি করেছেন [ভগবত গীতা অধ্যায় ৯, শ্লোক ২৩,২৪, গীতা অধ্যায় ৭ অনুচ্ছেদ ১৭,২০-২৩, গীতা ১০/৩৭, ১৮/৬৬; ঋগবেদ গ্রন্থ ১, পরিচ্ছেদ ১৬৪, অনুচ্ছেদ ৪৬, ঋগবেদ ২/৪৫/১৬, ৮/১/১, ১০/৪৮/১, ১০/৪৯/১, ১০/১২১/৩; যর্যুরবেদ ১৩/৪, ৩২/১১, ৪০/১, ৪০/৮-৯; অর্থববেদ ১০/৭/৩৮, ১৩/৪/১৬-২১, অথর্ববেদ সুক্ত ১৪/৪/২ ; উপনিষদ ৬/২/১, ৪/১০/২০; ছান্দোগ্য উপনিষদ , প্রাপাথাকা অধ্যায় ৬/২; শ্বেতাশ্বত্র উপনিষদ ৬/৯, ৪/১৯ ইত্যাদি]
কোরআনে আল্লাহ আরো বলেছেন -
যদি এতদুভয়ের (আসমান ও যমীনের) মধ্যে আল্লাহ ব্যতীত আরো অনেক ইলাহ থাকত, তাহলে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব, তারা যা বর্ণনা করে তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ কতই না পবিত্ৰ। (আল-আম্বিয়া, আয়াত ২২)
আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেননি, তাঁর সাথে অন্য কোন ইলাহও নেই। (যদি থাকত) তবে প্রত্যেক ইলাহ নিজের সৃষ্টিকে নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত; তারা যা বর্ণনা করে তা থেকে আল্লাহ কত পবিত্র! (আল-মুমিনুন আয়াত ৯১)
অনেকে এই আয়াত গুলোকে শুধু বানীই মনে করবে। যদি এই আয়াত গুলো বিশ্বাস নাও হয় তাহলেও সমস্যা নেই। আপনি নিজেই চিন্তা করুন আপন দুই ভাইকে যদি একটা জমি দেওয়া হয় তাহলে তারা সেটাকে ভাগ করে নিজেদের মত করে সেখানে যা ইচ্ছা তা করা শুরু করে অনেক সময় এই যায়গা-জমি নিয়ে তাদের মধ্যে মারামারিও হয়। যদি টাকা-পয়সা স্বর্ণ-হীরা দেওয়া হয় তাহলেত খুনাখুনি পর্যন্ত হয়। তাহলে এত বড় সৃষ্টির একের অধিক সৃষ্টিকর্তা থাকলে সৃষ্টির সব কিছু কিভাবে স্বাভাবিক থাকত? বেশি না হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ গুলো পড়লেই দেখা যায় দেব-দেবীর মধ্যে ঝগড়া, দেবগণের মধ্যে যুদ্ধ, দেবকে অপমান করছেন দেবী, দেবীকে অপমান করছেন দেব, এক দেব একজনকে শক্তি দেয় আরেক দেব তা কেড়ে নেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি হিন্দু ধর্মকে অপমান বা কঠাক্ষ করছি না আমি শুধু উদাহরন দিচ্ছি। এছাড়া হিন্দুরা যাদেরকে পুজা করে সেগুলা হল উপদেবতা, কিন্তু ধর্মে বলা আছে সৃষ্টিকর্তা একজন এবং তিনিই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।
১২ শতাব্দির একজন মুসলিম চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ইবনে রুশদ যিনি পশ্চিমা জগতের কাছে Averroes নামে পরিচিত, তিনি বলেন, “এই চরণটির মর্মার্থ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিতেই গেথে গেছে। এটি স্বতঃসিদ্ধ যে যদি একই শহরে দুইজন রাজা থাকে এবং প্রত্যেকের কাজই অভিন্ন। তাহলে তাদের উভয়ের পক্ষে একত্রে শহরের দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। কারণ দুটি একজাতীয় সত্বা কখনো এক এবং অভিন্ন কার্যসম্পন্ন করতে পারেনা। তাহলে এটাই বুঝায় যে দুজন একত্রে কাজ করলে শহরটি ধ্বংস হয়ে যাবে যদিনা একজনের কাজ করার সময় অপরজন অকার্যকরী হয়। এটি ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সাংঘর্ষিক। যখনই দুইটি একজাতীয় কার্যক্রম একই বিন্দুতে কোন ভিত্তির উপর ক্রিয়া করে, তখন ভিত্তিটি বিকৃত হবেই।” (Avorres. Faith and Reason in Islam. Avorres’ Explanation of Religious Arguments. ইব্রাহিম নাজ্জার দ্বারা (ইংরেজী) অনুবাদকৃত, One World, ২০০১, পৃষ্ঠা ৪০)
তবে লক্ষণীয় যে, আয়াতে এটা বলা হয়নি যে, যদি আসমান ও যমীনে আল্লাহ ব্যতীত আরো অনেক ইলাহ থাকত, তাহলে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। বরং বলা হয়েছে যে, ‘বিশৃংখল হত' বা ফাসাদ হয়ে যেত। আর সেটাই প্রমাণ করে যে, এখানে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহর ব্যত্যয় ঘটলে কিভাবে দুনিয়াতে ফাসাদ হয় সেটাই বোঝানো উদ্দেশ্য। কারণ, আল্লাহ ছাড়া অন্য মাবুদের ইবাদত করলে সেখানেই ফাসাদ অনিবাৰ্য। কিন্তু যদি দুই ইলাহ থাকত, তবে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত। এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, আয়াতটি যেভাবে তাওহীদুর রবুবিয়্যাহ বা প্রভুত্বে একত্ববাদের প্রমাণ, সাথে সাথে সেটি তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বা ইবাদাতের ক্ষেত্রে একত্ববাদেরও প্রমাণ। তবে এর দ্বারা তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বা ইবাদাতে একত্ববাদের প্রয়োজনীয়তাই বেশী প্রমাণিত হচ্ছে। [বিস্তারিত দেখুন, ইবন তাইমিয়্যাহ, ইকতিদায়ুস সিরাতিল মুস্তাকীম ২/৩৮৭: আন-নুবুওয়াত: ১/৩৭৬; ইবনুল কাইয়্যেম, মিফতাহু দারিস সা’আদাহ: ১/২০৬, ২/১১, ১২২; তরীকুল হিজরাতাইন ৫৭, ১২৫; আল-জাওয়াবুল কাফী ২০৩]
আইজাক নিউটন লিখেছেন: “ সূর্য, গ্রহসমূহ এবং ধূমকেতুসমূহের এই সুন্দর সিস্টেমটি কেবল একজন বুদ্ধিমান ও ক্ষমতাবান সত্ত্বার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই চালু থাকা সম্ভব।”–[সূত্র: Newton, Principia, 2nd Edition; J. De Vries, Essentials of Physical Science, B.EerdmansPub.Co., Grand Rapids, SD, 1958, p.155]