পৃথিবী গোল নাকি সমতল? পৃথিবীর আকার নিয়ে কোরআন ও বিজ্ঞান

পৃথিবীর আকৃতি নিয়ে কোরআন ও বিজ্ঞান কি সাংঘর্ষিক? চলুন দেখে নেওয়া যাক


 وَالۡاَرۡضَ بَعۡدَ ذٰلِكَ دَحٰٮهَا
অতঃপর তিনি জমিনকে বিস্তীর্ণ করেছেন। [সূরা আন নাযিআত আয়াত ৩০]
শব্দের অবস্থান অনুযায়ী শব্দ আলাদা আলাদা অর্থ প্রকাশ করে। এই আয়াতে دَحٰٮهَا দাহাহা শব্দ দিয়ে কি পৃথিবীর আকৃতি উট পাখির ডিমের মত বুঝানো হয়েছে? নাকি পৃথিবীকে সমতল বুঝিয়েছে? আধুনিক তাফসিরগুলুতে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছে , দাহাহা( دَحٰٮهَا ) শব্দের অর্থ ডিম্বাকৃতি। যেমনঃ
Dr.Kamal Omar তার অনুবাদে লিখেছে, And the earth,after this stage, He gave it an oval form.
Sayed Vickar Ahamed তার অনুবাদে লিখেছে, He has extended the earth(far and wide also in the shape of an egg)

দাহাহা শব্দের অর্থ ডিম্বাকৃত অথবা প্রসারিত করা, দুইটাই সঠিক তাই আগেরকার তাফসিরসমূহে দাহাহা শব্দের অনুবাদ করেছে “প্রসারিত করা বা বিছিয়ে দেওয়া”।  

প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে আগেরকার তাফসীর গুলো কি ভুল ব্যাখ্যা করছে? উত্তরঃ না, কেননা দুইটা ব্যাখ্যা সঠিক।  And after that He spread the earth.& He made the earth egg shape. earth শব্দের অর্থ, পৃথিবী ,মাটি, ভূমি, জমি ইত্যাদি। এখানে “Spread” শব্দটাই ঠিক করে দিবে যে “earth” মানে কি “জমিন” বুঝানো হয়েছে নাকি “পৃথিবী” বুঝানো হয়েছে।

যদি “earth” অর্থ “জমিন” ধরে নেই তাহলে “Spread” অর্থ হবে “বিস্তীর্ণ” । ফলে এই আয়াতের অর্থ হবে, এরপর আল্লাহ জমিনকে বিস্তীর্ণ করেছেন।আমাদের বসবাসের জন্য।
যদি “earth” অর্থ “পৃথিবী” ধরে নেই তাহলে “Spread” অর্থ হবে “ডিম্বা আকৃতি”।
ফলে এই আয়াতের অর্থ আসবে , এরপর আল্লাহ পৃথিবীকে ডিম্বাকৃতি করেছেন।

আরবিতে দাহাহা শব্দের অর্থ কি জানেন? দাহাহা শব্দের অনেক গুলো অর্থ আছে।

যার মধ্যে রয়েছে ,বিস্তিত, প্রসারিত ,ডিমের আকারের,সম্প্রসারিত,ছড়িয়ে পড়া,বৃত্তাকার তৈরি,সুষম। রেফারেন্সঃ wordsense
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) আবু-হুসাইন ইবনুল মুনাদী (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন, যখন তিনি বলেছিলেন:  ইমাম আবু-হুসাইন আহমদ ইবনে জাফর বিশিষ্ট আলেমদের থেকে বর্ণনা করেছেন, যারা আহমদ ইবনে হাম্বলেন সঙ্গীদের দ্বিতীয় স্তরের ধর্মীয় পন্ডিত ছিলেন তারা  সর্বসম্মতিক্রমে একমত হয়েছিল যে পৃথিবী, যা কিছু জমি এবং সমুদ্র রয়েছে তার সবই একটি বলের মতো। তিনি বলেছিলেন: এটি এই সত্য দ্বারা নির্দেশিত যে সূর্য, চাঁদ এবং তারাগুলি একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে যারা থাকে তাদের উপরে উঠে না এবং অস্ত যায় না; বরং এটি পশ্চিমে হওয়ার পূর্বে পূর্বে ঘটে। (মাজমু আল-ফাতাওয়া ২৫/১৯৫)  
আবু মুহাম্মাদ ইবন হাজম (রহ) বলেছেনঃ (পৃথিবী গোল এ কথার) বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দেয়া হয় আমরা এর কয়েকটির ব্যাপারে আলোচনা করব।  তাঁরা বলেন, পৃথিবী গোল এ ব্যাপারে ভালো প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু আম জনতা এর বিপরীত কথা বলে। আল্লাহর তাওফিকে এ ব্যাপারে আমাদের জবাবঃ মুসলিম উম্মাহর কোনো ইমাম অথবা ইলমের দ্বারা যারা ইমাম অভিধা লাভের যোগ্য (আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন) – তাদের কেউই এ কথা অস্বীকার করেননি যে পৃথিবী গোল। তাঁদের থেকেই কথা অস্বীকার করে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়নি। বরং কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত হয় যে এটি (পৃথিবী) গোল। [আল ফাসল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া’ ওয়ান নিহাল ২/৭৮]

 وَ اِلَی الۡاَرۡضِ کَیۡفَ سُطِحَتۡ 

আর যমীনের দিকে, কীভাবে তাকে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে? [সুরা গাশিয়াহ, আয়াহ ২০]

আরবি ভাষাতে একটা শব্দের অনেকগুলা অর্থ রয়েছে। এই আয়াতেও سُطِحَتۡ ‘সুতিহাত’ এর অর্থ অনেকে সমতল ধরে পৃথিবীকে সমতল বলে, কিন্তু এই আয়াতেরও অনেক গুলা অর্থ আছে। 

যার মধ্যে রয়েছে, বিস্তৃত, বিছানো, ছড়িয়ে পড়া, সমতল, প্রসারিত ইত্যাদি।  Google Translate
তাফসীরে আহসানুল বায়ান এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে, ‘এমন ভাবে তাকে সমতল বানিয়ে মানুষের বসবাসের উপযোগী করা হয়েছে। তাতে মানুষ চলা-ফেরা ও কাজ-কারবার করে এবং আকাশ-চুম্বি উচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ করে থাকে। এছাড়া বেশির ভাগ তাফসির কারক এই শব্দের ‘বিস্তৃত’ ‘বিছানো’ শব্দগুলোকে অর্থ হিসেবে গ্রহন করেছেন। রেফারেন্স
আবু আল-ফারাজ ইবনে আল-জাওজি, আবু মুহাম্মদ ইবনে হাজিম, শেখ ইবনে উসাইমীন, শেখ আল-শানকীতি, আবু মুহাম্মাদ ইবনে হাযম, ইবনে তাইমিয়া, ইমাম আবু ইয়ালা, শেইখ বিন বায, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযি ইত্যাদি ব্যাক্তিবর্গ এবং ফতুয়ার গ্রন্থ আল-আল-আমানিয়াহ: নাশাতুহা ওয়া তাতাওয়ারুহা, ফাতাওয়া নূর ‘আলা আদ-দরব’ তাফসির আল-রাজী, আল-ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহ-ওয়া আল মিলাল, মাজমু ফাতোয়া, তাবাকাত আল-হাম্বলী, মাফাতিহুল গাইব, নুরুন আলাদ দারব ইত্যাদি ততকালিন মুসলিম স্কলারদের এইসব গ্রন্থে পৃথিবী গোল উল্লেখ আছে। বিভিন্ন ফিকহ ওয়েবসাইটে ও ফতুয়ার ওয়েবসাইটে আপনারা সেই সব প্রমান পেয়ে যাবেন যেখানে অনেক বড় বড় ইসলামিক স্কলাররা যারা পৃথিবীকে সমতল দাবি করে তাদের যুক্তি ও প্রমান খন্ডন করেছেন চাইলে দেখে আসতে পারেন। প্রমান - [১] , [২] , [৩] , [৪] , [৫]                         

আবু হাফস ইবন আদিল আদ-দিমাশকি বলেন, "অর্থাৎ ভূমিকে প্রস্তত, বিস্তৃত ও প্রসারিত করা হয়েছে। কেউ-কেউ এই আয়াত-কে দলিল হিসেবে নিয়ে বলেছেন যে, পৃথিবী গোল নয়। এদের জবাবে ইবনুল খাতিব বলেন, এই আয়াত থেকে পৃথিবী গোল নয় বলাটা দুর্বল যুক্তি, কেননা যখন একটা গোলাকৃতি বস্তু আয়তনে খুবই বড় হয় তখন তার প্রতিটি অংশ সমতলের মত মনে হয়।"[আললুবাব ফি উলুমিল কিতাব (২০/৩০২)] সামিউল হাসান তবিব আল-ইনফিরাদী ভাই সূরা রাদ আয়াত ৩ ও সূরা গাসিয়া আয়াত ২০ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অনেক স্কলারের বক্তব্য তুলে ধরেছেন এই পোষ্টগুলোকে - [১] , [২] 

 وَ الۡاَرۡضَ مَدَدۡنٰهَا وَ اَلۡقَیۡنَا فِیۡهَا رَوَاسِیَ وَ اَنۡۢبَتۡنَا فِیۡهَا مِنۡ کُلِّ شَیۡءٍ مَّوۡزُوۡنٍ

আর যমীনকে আমি বিস্তৃত করেছি এবং তাতে সুদৃঢ় পাহাড় স্থাপন করেছি। আর তাতে উৎপন্ন করেছি সকল প্রকার বস্তু সুনির্দিষ্ট পরিমাণে। [সুরা হিজর, আয়াত ১৯]

কোরআনের এ আয়াত পাঠ করে ইমাম ইবনে হাজম আন্দালুসি (রহ) পৃথিবী গোলাকার হওয়ার কথা বলেছিলেন। (ইবনে হাজম, আল-ফিছাল ফিল মিলাল ১/৩৫২)
وَ الۡاَرۡضَ فَرَشۡنٰهَا فَنِعۡمَ الۡمٰهِدُوۡنَ
আর আমি যমীনকে বিছিয়ে দিয়েছি। আমি কতইনা সুন্দর বিছানা প্রস্তুতকারী! [সূরা আয-যারিয়াত আয়াত ৪৮]
مَاهِدُونَ শব্দের অর্থ দুটি। এক. বিছানার মত সুন্দরভাবে বিছিয়ে দেয়া। দুই. সুন্দর ব্যবস্থাপনা তৈরী করা [তাফসীর আল কুরতুবি , ফাতহুল মাজিদ / সুরা আয যারিয়াত আয়াত ৪৮] রেফারেন্স
 الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ مَهۡدًا وَّ سَلَکَ لَکُمۡ فِیۡهَا سُبُلًا وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً ؕ فَاَخۡرَجۡنَا بِهٖۤ اَزۡوَاجًا مِّنۡ نَّبَاتٍ شَتّٰی
যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা এবং তাতে করে দিয়েছেন তোমাদের জন্য চলার পথ, আর তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দিয়ে আমরা বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। [সূরা ত্বহা আয়াত ৫৩]
অন্যান্য আগের তাফসীর গুলোতে এই আয়াতের ব্যখ্যা দিতে গিয়ে বলেছে, “জমিনকে বিস্তীর্ণ করেছে বা বিছানা হিসেবে নির্মান করতে” বলতে বুঝানো হয়েছে যে ,জমিনকে আমাদের বসবাসের উপযোগী করা হয়েছে। সুতরাং এখানে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, বিস্তীর্ণ করা বা বিছানো বলতে পৃথিবীর আকৃতি সমতল বুঝানো হয়নি। রেফারেন্স 
الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ مَهۡدًا وَّ جَعَلَ لَکُمۡ فِیۡهَا سُبُلًا لَّعَلَّکُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ
যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে বানিয়েছেন শয্যা এবং তাতে বানিয়েছেন তোমাদের চলার পথ, যাতে তোমরা সঠিক পথ পেতে পার। [আয-যুখরুফ আয়াত ১০]
এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে, উদ্দেশ্য এই যে, পৃথিবীর বাহ্যিক আকার শয্যা বা বিছানার মত এবং এতে বিছানার অনুরূপ আরাম পাওয়া যায়। সুতরাং এটা গোলাকার হওয়ার পরিপন্থী নয়। অন্যান্য স্থানেও পৃথিবীকে বিছানা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। [সূরা ত্বা-হা: ৫৩, সূরা আন নাবা: ৬] লক্ষণীয় যে, যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছে, مهد শব্দটির এক অর্থ হচ্ছে, সুস্থির বিছানা বা শয্যা। অপর অর্থ হচ্ছে, দোলনা। অর্থাৎ একটি শিশু যেভাবে তার দোলনার মধ্যে আরামে শুয়ে থাকে মহাশূন্যে ভাসমান এই বিশাল গ্রহকে তোমাদের জন্য তেমনি আরামের জায়গা বানিয়ে দিয়েছেন। [ইবনে কাসীর, জালালাইন, আয়সার আত-তাফসির] রেফারেন্স
  الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّکُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰهِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ
যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিয্কস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। [সূরা বাকারা আয়াত ২২]
এই আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ পৃথিবীকে বিছানা সরূপ করেছের অর্থাৎ আরামদায়ক যায়গা। এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীকে সমতল বলাও বোকামি ছাড়া কিছুই না।
এছাড়া আরো পৃথিবীকে আল্লাহ বৃস্তির্ন করেছেন এই কথা বলা হয়েছে সূ. নূহ আ. ১৯, সূ. নাবা আ. ৬, সু. শামস আ. ৬,  সূ. ক্বাফ আ. ৭ ইত্যাদি আয়াতে। তাহলে কি কোরআনে বৈজ্ঞানিক ভুল আছে! নাউজুবিল্লাহ। 
মুহাম্মাদ আত-তাহির বিন আশুর বলেন, "তারপর নাজিল হয়েছে তারা তাদের পায়ের তলদেশে যেই ভুমিটা দেখতে পায়; সেটা সম্পর্কে যা কিনা তাদের জন্য চারণ ক্ষেত্র ও শোয়া-বসার জায়গা। আল্লাহ এই ভূমিকে সাতাহ করেছেন অর্থাৎ তিনি তাকে চলাচল, বসা ও শোয়ার জন্য উপযুক্ত করেছেন। সাতাহ এর মানে হলো সমান করা, এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, এখানে সম্পূর্ন গোল পৃথিবী উদ্দেশ্য নয়। বরং একটা মানুষের দল যে একটি নির্দিষ্ট পরিমান ভূমিতে থাকে সেই ভূমির একটি অংশ উদ্দেশ্য।" [আত-তাহরির ওয়াত তানওইর (৩০/৩০৬)]  
আলবানি (রহ) বলেন, “আর পৃথিবী গোল হওয়া এবং ঘূর্ণন প্রক্রিয়া এই আয়াতের পরিপন্থি নয় : كل في فلك يسبحون প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করছে। [সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৩] পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য সবকিছু নিজস্ব কক্ষপথে চলছে। এই মাসআলা নিয়ে পূর্বের আলেমগণ কোনো আলোচনা করেন নি। কারণ, এটা জাগতিক বিষয়, শরয়ী বিষয়ের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। প্রত্যেকে তাই বিশ্বাস করবে যা তার কাছে প্রাধান্যযোগ্য মনে হবে। আমরা সন্দেহ করি না, যেমনটা ইবনুল কাইয়্যিমের মতো কিছু পূর্ববর্তী আলেম থেকে প্রমাণিত আছে যে, পৃথিবী গোল।” [ফাতাওয়ায়ে আলবানী পৃষ্ঠা ৩৬৪]

যারা এসব আয়াত দিয়ে বলে কোরআনে বিছানো, বিস্তৃর্ণ, কার্পেটের মত বলতে পৃথিবীকে সমতল বলা হয়েছে তাদেরকে বলি কারও চেহারার প্রশংসা করে যখন ‘চাঁদমুখ’ বলা হয়, তখন ‘চাঁদমুখ’ বলতে কিন্তু চাঁদের মত গোলাকার কোন মুখ বুঝায় না; বরং সৌন্দর্যের কথা বুঝায়। তাই কার্পেট বা বিছানা বললেই যে সেটা দিয়ে সমতল বুঝানো হচ্ছে- এরকম যুক্তি আসলে কুযুক্তি ছাড়া কিছু নয়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে প্রায় আয়াতে উল্লেখ করা বিছানা/কার্পেটের সংজ্ঞা কি? এর উত্তর হচ্ছে এমন কোন কিছু যার উপর আমরা আরাম অনুভব করি। আপনি জানেন কি পৃথিবীর অনেকগুলো লেয়ার আছে? পৃথিবীর নিছে প্রায় ৭টা লেয়ার রয়েছে। এই লেয়ারগুলোর সবচেয়ে উপরে আছে Crust।  এটি সবচেয়ে পাতলা আস্তরণ। আমরা যেখানে দাড়িয়ে আছি, সেই Crust-এর আয়তন মাত্র ৩০ কিমি। এই লেয়ারটাই আমাদের বসবাসের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। বাকিগুলা বসবাসের জন্য চরম অনুপোযোগী, আর পৃথিবীতে এই Crust-এর মাত্রা মোট আয়তনের মাত্র ১%। এবার বলুন, আপনি এই ক্রাস্টের কথা সহজ ভাবে বুঝাতে কোন শব্দটি ব্যবহার করতেন? এখানে বিছানা/কার্পেটই সবচেয়ে উপযুক্ত শব্দ। কারণ ভূপৃষ্ঠ বা ক্রাস্টের লেয়ার খুবই পাতলা। বিছানা, কার্পেটও পাতলা আস্তরণ। ক্রাস্ট যেমন আমাদের বসবাসের জন্য আরামদায়ক, তেমনি বিছানা, কার্পেটও আরামদায়ক করার জন্যই বিছানো হয়।

আপনি যদি কুরআনের বিছানা বা কার্পেট সংক্রান্ত আয়াতগুলো দেখেন- তাহলে দেখবেন- ভূমিকে বিছানো হয়েছে- এই কথা বলার সাথে সাথেই তোমরা চলাফেরা করতে পারো, ফসল উৎপন্ন করতে পারো- এই কথাগুলো বলা হয়েছে। কথাগুলো দিয়ে ক্রাস্টের ব্যাপারটা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ব্রেইন ওয়াশ্ড নাস্তিকদের এগুলো চোখে পড়ে না।

আবার অনেকে প্রশ্ন করে আল্লাহ কোরআনে অনেক যায়গায় বলেছেন তিনি আকাশকে ছাদ হিসেবে তৈরি করেছেন আর ছাদত সমতলই হয়। এখানে একটা জিনিস লক্ষনীয় যে ছাদ কিন্তু অন্য অর্থে ও ব্যবহার হতে পারে। যেমন কারো বাবা-মা মারা গেলে অনেকে বলে সন্তানদের মাথার উপর থেকে ছাদ চলে গেছে এখানে কিন্তু ছাদ আসলে লালন-পালন ও সুরক্ষা অর্থে ব্যবহার হয়েছে। আবার অনেকে বলে আমাদের মাথার উপর ছাদ নেই এখানে আবার ছাদ ঘর বুঝাতে ব্যবহার হয়েছে। আর আপনারা হয়ত যানেন যে পৃথিবীতে আকাশের ৭ টা স্তর রয়েছে যেগুলা বিভিন্ন কাজ রয়েছে এবং সেগুলা আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন বিপদ ও ক্ষতিকর জিনিস থেকে নিরাপদে রাখার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভুমিকা পালন করে। সে হিসেবে পৃথিবীর আকাশকে ছাদের সাথে তুলনা করাটা একদম স্বাভাবিক বিষয়, আবার সব ছাদ যে সমতল হয় বা হবে এমনটাও নয়। তাই ছাদের সাথে তুলনা করলেই যে সেটা সমতল হতে হবে এমন চিন্তা করাটা একদমই যুক্তিসংঘত নয়। 

আমরা যদি চারপাশে তাকাই, তাহলে কিন্তু পৃথিবীকে আমাদের কাছে সমতলই মনে হয়। কারণ পৃথিবী এত বড় গোলক যা নির্দিষ্ট কোন স্থান থেকে সমতলই মনে হবে। বিজ্ঞানের যে পরীক্ষাগুলোতে পৃথিবীর ছোট কোনো অংশ বিবেচনা করা হয় সেখানে কিন্তু সমতলই ধরা হয়। তবে বৃহৎ দুরত্বে অবশ্যই গোলাকার। আপনি যদি পৃথিবীর surface area, circumference-এর কথা চিন্তা করেন, সেটা অবশ্যই বিশাল। এই বিশাল জায়গাকে দেখলে বিস্তৃতই মনে হয়; এটা পৃথিবীর সমতল হওয়া প্রমাণ করে না।

এছাড়া এসব আয়াতের একটা অর্থ হচ্ছে প্রসারিত করা। সূরা নাজিয়াতের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে প্রসারণের পর তৈরি হয়েছে জল, চারণভূমি- তারমানে প্রসারণের আগে এগুলো ছিল না। এ থেকে বুঝা যায়, আয়াতটি পৃথিবী সৃষ্টির সময়কালের কথা বুঝাচ্ছে। কিছুদিন আগে বিজ্ঞানীরা প্রমান পেয়েছে যে আমাদের পৃথিবী প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু একদম সঠিক ভাবে তারা বলতে পারছে না যে কতটুকু পরিমানে বাড়ে কিন্তু বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে পৃথিবীর ব্যাসার্ধের গড় পরিবর্তন প্রতি বছর 0.004 ইঞ্চি (0.1 মিলিমিটার) হতে পারে, অথবা মানুষের চুলের পুরুত্ব সম্পর্কে, যা পরিসংখ্যানগতভাবে তুচ্ছ বলে বিবেচিত।

এছাড়াও অন্য আয়াত দ্বারা আল্লাহ পৃথিবীর আকৃতি কে করেছে গোলাকার সেই দিকে ইঙ্গিত করছেন।
রেফারেন্সঃ তিনি রাত্রি দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাত্রিকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা।” [সূরা আয-যুমার আয়াত ৫] ও তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের রব। [আর রহমান আয়াত ১৭]

 তেমন জমিনকে বিস্তীর্ণ করেছেন আমাদের বসবাসের জন্য ।

রেফারেন্সঃ আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি, তাতে পর্বতমালার ভার স্থাপন করেছি এবং তাতে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ উদগত করেছি।” [সূরা কাফ আয়াত ৭] 

সূরা ইনশিকাকের বলা হয়েছে,

আর যখন যমীনকে সম্প্রসারিত করা হবে। [সূরা ইনশিকাকা আয়াত ৩]
এই আয়াতের তাফসিরে আবার একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, “কেয়ামতের দিন পৃথিবীকে চামড়ার ন্যায় টেনে সম্প্রসারিত করা হবে। তারপর মানুষের জন্য সেখানে কেবলমাত্র পা রাখার জায়গাই থাকবে।” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ৪/৫৭১]
বলেন ত্রি-মাত্রিক গোল পৃথিবীকে টেনে সম্প্রসারিত করে আল্লাহর পক্ষে সমতল করা সম্ভব না?
রসূলুল্লাহ (সা)  বলেছেন, “সমস্ত ভূখণ্ড কিয়ামাতের দিন একটি রুটির মতো হয়ে যাবে। আল্লাহ সেটি নিজ হাতে এপাশ-ওপাশ করবেন,যেমন তোমাদের মাঝে কেউ সফরের সময় নিজ রুটি এপাশ-ওপাশ করে।” [সহিহ মুসলিম,হাদিস নং ৬৯৫০]
রুটি কিন্তু বেলার আগে বলের মতনই থাকে, আমরা সেইটারে বেলন দিয়া strech বা expand করে কিন্তু ফ্ল্যাট করি। একটু ভাবুন

যেমনটি আল্লাহ কিয়ামতের সময় পৃথিবীকে সমতল করবেন বলেছেন।

‘তারপর তিনি তাকে মসৃণ সমতলভূমি করে দিবেন’। [সূরা ত্ব-হা আয়াত ১০৬]

এখন চিন্তা করে দেখুন যদি কোরআনে আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালা পৃথিবীকে সমতল বলে থাকেন তাহলে সেই সমতল পৃথিবীকে আবার সমতল করার কি প্রয়োজন? তার মানে বুঝাই যাচ্ছে উক্ত আয়াতে বিস্তীর্ণ বা বিছানো বলতে সমতল বুঝানো হয়নি।

চলতে চলতে যখন সে সূর্যাস্তের স্থানে পৌঁছল, তখন সে সূর্যকে অস্বচ্ছ জলাশয়ে ডুবতে দেখল আর সেখানে একটি জাতির লোকেদের সাক্ষাৎ পেল। আমি বললাম, ‘হে যুলকারনাইন! তুমি তাদেরকে শাস্তি দিতে পার কিংবা তাদের সঙ্গে (সদয়) ব্যবহারও করতে পার।’ [সূরা কাহাফ আয়াত ৮৬]
এ আয়াতে দেখা যাচ্ছে যুলকারনাইন সূর্যকে পানিতে ডুবে যেতে দেখলেন। চিন্তা করে দেখেন আল্লাহ যদি পৃথিবীকে সমতলই বলতেন তাহলে যুলকারনাইন কিভাবে সূর্যকে পানিতে ডুবে যেতে দেখলেন? কারন সমতল পৃথিবীর যে কোন বিন্দু থেকে সূর্য পর্যন্ত সরলরেখা আকা সম্ভব, আর সেক্ষেত্রে সূর্য কখনওই দিগন্তের নিচে যেত না,আর যুলকারনাইনের নিকট সূর্য পানিতে ডুবছে বলে মনে হতো না। তার মান কুরআন পৃথিবীকে সমতল বলছে না এটাত উপরের আয়াত গুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল।
সমতল শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে  ‘سابي’  ‘المستعبى’  ‘مسطحة’ ইত্যাদি। কুরআন যদি সত্যিই পৃথিবীকে সমতল বলত তাহলে কোরআনে নিশ্চই এই শব্দগুলার ব্যবহার থাকত কিন্তু এমনটা নেই।
 
 সূরা যুমার আয়াত নং ৫, আল্লাহ বলেন,
خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ بِالۡحَقِّ ۚ یُکَوِّرُ الَّیۡلَ عَلَی النَّهَارِ وَ یُکَوِّرُ النَّهَارَ عَلَی الَّیۡلِ وَ
سَخَّرَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ کُلٌّ یَّجۡرِیۡ لِاَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ اَلَا هُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡغَفَّارُ ﴿۵
তিনি যথাযথভাবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা। সূর্য ও চন্দ্রকে তিনি করেছেন নিয়মাধীন। প্রত্যেকেই পরিক্রমন করে এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। জেনে রেখো, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।
শেখ ইবনে উসাইমীন সূরা যুমার আয়াত নং ৫ পাঠ করে বলেছিলেন এই আয়াতই পৃথিবী গোল হওয়ার প্রমান।
তাফসির,থেকে কিছু অংশ, আয়াতটিতে যে আরবি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি হলো “يُكَوِّرُ”। এর অর্থ এক বস্তু কে অপর বস্তুর উপর পেচিয়ে দেওয়া। যেমনটা মাথার পাগড়ির ক্ষেত্রে বুঝানো হয়।আমরা ভালোভাবেই জানি, পাগড়ি কিভাবে গোলাকারভাবে প্যাঁচানো হয়।এই আয়াতে বলা হচ্ছে , রাত্রি আনয়ন করে দিনকে ঢেকে দিয়ে তার আলো শেষ করে দেওয়া এবং দিনকে রাত্রির পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে দেওয়ার অর্থ হল, দিন আনয়ন করে রাত্রিকে ঢেকে দিয়ে তার অন্ধকার শেষ করে দেওয়া। এ ঘটনা কেবল পৃথিবী অনেকটা গোলাকার হলেই ঘটতে পারে। একেবারে গোল হতে হবে এমনও নয় কিছুটা গোল হলেও পাগড়ি পড়া যায়। তার মানে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পৃথিবীকে একবারে গোল আকৃতির সেটা বলছেন না তিনি শুধু ইঙ্গিত করেছেন যে পৃথিবী প্রায় গোল। (সম্পূর্ণ গোল আকৃতি নয়)
 
 সূরা আর রহমান আয়াত ১৭
رَبُّ الۡمَشۡرِقَیۡنِ وَ رَبُّ الۡمَغۡرِبَیۡنِ
তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের রব।
দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের বলতে হয়ত আল্লাহ দুই গোলার্ধের কথা বলেছেন। এর কারণ কুরআনের অন্য এক স্থানে বলা হয়েছে, (فَلَا أُقْسِمُ بِرَبِّ الْمَشَارِقِ وَالْمَغَارِبِ إِنَّا لَقَادِرُونَ অর্থাৎ, অতএব আমি শপথ করছি উদয়াচলসমূহ এবং অস্তাচলসমূহের রবের-অবশ্যই আমরা সক্ষম [সূরা আল-মা'আরিজ: ৪০]। অনুরূপ পৃথিবীর এক গােলার্ধে যখন সূর্য উদয় হয় ঠিক সে সময় অন্য গোলার্ধে তা অস্ত যায়। এভাবেও পৃথিবীর দু'টি উদয়াচল ও অস্তাচল হয়ে যায়। পৃথিবী যদি অনেকটা গোলাকৃতির না হত তাহলে আল্লাহ কোরআনে দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের মানে দুই গোলার্ধের কথা কখনোই বলতেন না। গোলাকার পৃথিবী ছাড়া দুই গোলার্ধ বা দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচল হত না সেটা সবাই যানে। এখানেও বলা হচ্ছে পৃথিবী অনেকটা গোল কিন্তু সম্পূর্ণ গোল সেটা বলেনি।

আমরা সকলেই জানি রুটি তৈরির সময় আগে আটাকে গোল বলের আকৃতির মতো বানানো হয়। পরবর্তীতে সেই আটার বলটিকে চ্যাপ্টা বানানো হয়। অনুরূপভাবে পৃথিবীও বর্তমানে আটার বলের মতো গোলাকার অবস্থায় আছে। কিয়ামতের দিন পুরো পৃথিবী নামক বলটিকে চ্যাপ্টা বানিয়ে সেই রুটির মতো করা হবে।
এই আয়াত গুলো থেকে প্রমাণিত হয় আল্লাহ কোরআনে পৃথিবীর আকৃতি যে অনেকটা গোল সেটাই বলেছেন।আমরা যদি পৃথিবীর অরিজিনাল আকারের দিকে তাকাই তাহলে দেখব পৃথিবী ১০০% গোলাকার না। একদিকে কিছুটা উচু একদিকে কিছুটা নিচু তাই আমাদের পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরনের মান সব যায়গায় সমান না।
Ashraful Nafiz

I am an ordinary Muslim student who is interested in acquiring the beneficial knowledge given by Allah and hopes to spread that knowledge among the people. facebook youtube twitter instagram quora

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Would you tell me something

নবীনতর পূর্বতন