কোনটা উচিৎ আর কোনটা অনুচিৎ সেটা উপলব্ধি করতে অনেক দেরি করে ফেলি আমরা

অতীতে ফিরে গিয়ে গল্পের শুরুটা কখনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, হয় তুমি এখন বুঝতে পারছ, উপলব্ধি করতে পেরেছ তুমি এতদিন যা করেছ তা ঠিক ছিল না। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই কারন যখন তুমি উপলব্ধি করতে পেরেছ তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

একটি শিক্ষনীয় গল্প 

আমার নাম নাফিজ। ভার্সিটিতে প্রথম যেদিন ক্লাস করতে যাই সেদিন স্যার একে একে সবার সাথে পরিচিত হচ্ছিলো। আমি যখন দাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিবো তখন স্যার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

 - তুমি কি আই এসের সদস্য? এই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো জঙ্গি হামলা করার জন্য না কি? 

স্যারের কথা শুনে ক্লাসের সবাই হাসতে লাগলো। আমি মাথাটা নিচু করে স্যারকে বললাম, স্যার, আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না। স্যার আবারও হাসতে হাসতে বললো, 

- তোমার মুখ ভর্তি দাড়ি দেখে তো এটাই মনে হলো। 

সেদিনের পর কেউ আমাকে আশরাফুল নাফিজ বলে ডাকে না। সবাই জঙ্গি নাফিজ বলেই ডাকে। স্যারকে দেখতাম মাঝে মাঝেই মজার ছলে আমাকে নানা রকম অপমান করতো। সেদিন স্যার আমাকে দেখিয়ে সবাইকে বললো, 

- নাফিজের থেকে কিছু শিখো তোমরা। ৩ দিন পর পর সেভ করলে নাপিতকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা দিতে হয়।কিন্তু বাশারের দিতে হয় না কারণ সে দাড়ি রেখে দিয়েছে৷ একটা ভালো জিন্স প্যান্ট কিনতে গেলে ২৫০০ টাকা লাগে একটা ভালো শার্ট কিনতে গেলে ১৫০০ টাকা লাগে কিন্তু নাফিজের এইসব কিছুই লাগে না। সে ৫০০ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবি পায়জামা বানিয়ে ফেলতে পারে। তোমরা ছেলেরা সবাই খরচ কমাতে নাফিজকে ফলো করো। 

স্যারের মুখ থেকে এইসব কথা শুনে ক্লাসের সবাই হাসতে লাগলো। আর আমিও সেদিন প্রথম স্যারের চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে স্যারকে বললাম, 

- স্যার, দুইদিন পর যখন মারা যাবেন তখন কিন্তু ক্লিন সেভ করা, উন্নত মানের জিন্স প্যান্ট আর শার্ট পরিহিত কেউ এসে আপনার জানাজার নামাজ পড়বে না। তখন কিন্তু আমারি মত দাড়িওয়ালা ৫০০ টাকার পাঞ্জাবি পায়জামা পরিহিত কেউ এসে আপনার জানাযার নামাজটা পড়বে। 

এইবার স্যারকে দেখলাম মাথা নিচু করে আছে। ক্লাসের সবাই নিরব। আর আমি তখন মুচকি হেসে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসলাম।

ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে জেসমিন নামের একটা মেয়েকে টিউশনি করাতাম। ১মাস পড়ানোর পর ছাত্রীর বাবা বেতনের টাকাটা আমার হাতে দিয়ে বললো, 

- কাল থেকে তোমার আর আসতে হবে না। 

আমি অবাক হয়ে বললাম, 

- আংকেল, কারণটা কি জানতে পারি? 

আংকেল তখন রেগে গিয়ে বলতে লাগলো, 

- তুমি আমার মেয়েকে সব সময় মরার ভয় দেখাও কেন? পর্দা না করলে আখিরাতে এই হবে ঐ হবে এইসব বলে আমার মেয়ের মাথা নষ্ট করে দিয়েছো। আমার মেয়ে মাথায় ওড়না দিলো কি দিলো না তাতে তোমার  কি? তোমার এসব জ্ঞান অন্য কোথাও গিয়ে দেখাও।  

একটু পর ছাত্রীর মা এসে বললো,  

- নজর ঠিক তো সব ঠিক। নজর ঠিক থাকলে এইসব পর্দা করার কোন দরকার নেই। তোমার এইসব হুজুরগিরি অন্য মেয়েকে দেখাও, আমার মেয়েকে দেখাতে এসো না।  

আমি মুচকি হেসে ছাত্রীর বাবা মারদিকে তাকিয়ে বললাম,

- সবচেয়ে বড় শিক্ষক হলো বাবা মা। যে ঘরে আপনাদের মত বাবা মা আছে সেই ঘরের মেয়েরা বেপর্দা হবে এটাই স্বাভাবিক। আপনারা কত বড় ভুল করেছেন সেটা এখন না কয়দিন পর হয়তো বুঝবেন।

৭ মাস পর খবরের কাগজে একটা ছবি দেখে চমকে উঠলাম। আমার ছাত্রী জেসমিনের বাবা মার আর্তনাদের ছবি। ছবির উপরে লাল কালি দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা, অন্তরঙ্গ ভিডিও ফাস হওয়ার জন্য তরুণীর আত্মহত্যা। আমি খবরের কাগজটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে লাগলাম, এই মৃত্যুর জন্য মা বাবাও দায়ী। মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিলে হয়তো এমনটা হতো না। 

আমার বিয়ের কয়েকদিন পর আমার স্ত্রী অহনা আমায় বললো, আমার সাথে আর একদিনও সংসার করতে পারবে না। ও স্বাধীনতা চায়, পর্দার আড়ালে নিজেকে আবদ্ধ করতে পারবে না। অনেক বুঝানোর পরেও সে বুঝলো না। তাই বাধ্য হয়ে অহনাকে ডিভোর্স দিলাম। বছর দুয়েক পর, ফুলের দোকানের সামনে যখন আমিদাঁড়িয়ে আছি। তখন কে যেন আমায় পিছন থেকে ডাকলো। পিছন ফিরে দেখি অহনা। অহনা আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বললো, 

- কেমন আছেন? 

আমি হেসে উত্তর দিলাম, 

- আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি? 

আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে অহনা বলবো, 

- ফুলের দোকানে কেন? 

এমন সময় ফুলের দোকানের কর্মচারী ছেলেটা কোথা থেকে যেন দৌড়ে আমার কাছে এসে বললো, 

- ভাই আজ তো বেলী ফুল পাই নি। আশে পাশের দোকানেও খুঁজে পেলাম না। তবে একজনকে ফোন দিয়েছি। ২০ মিনিট পর নিয়ে আসবে আপনি একটু অপেক্ষা করেন। আমি অহনাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। অহনা অবাক হয়ে বললো, 

- দোকানের ছেলেটা এত উতলা হয়ে আপনার জন্য বেলীফুল খুঁজছে কেন? 

আমি মুচকি হেসে উত্তর দিলাম, 

-আমি প্রতিদিন বাসায় ফেরার সময় আমার স্ত্রী নাঈমাহর জন্য এই দোকান থেকে বেলী ফুল কিনে নিয়ে যাই। নাঈমাহর খুব পছন্দ বেলীফুল...

আমার আর অহনার জন্য যখন খাবার অর্ডার করলাম তখন আমি ওয়েটারকে বললাম, 

- আমায় যে খাবারটা দিবে তার থেকে অর্ধেক যেন আমায় পার্সেল করে দেয়। 

অহনা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 

- হঠাৎ পার্সেল কেন? 

আমি মাথাটা নিচু করে হেসে বললাম, 

- আমি তোমার সাথে এইখাবারটা খাবো আর নাঈমাহ এই খাবারটা খাবে না সেটা হয় নাকি! তাই ওর জন্য আমার অর্ধেক খাবার নিয়ে যাবো... 

খাওয়া শেষ করে যখন আমি পার্সেলটা হাতে নিয়ে বের হবো তখন অহনা বললো, 

- আমি ভালো নেই। আপনার সাথে ডিভোর্সের পর আমি খুব স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে বিয়ে করি। কিন্তু বিয়ের পর দিন থেকে আমি একটুও সুখে নেই। স্বামীর চোখে আমি শারিরীক ক্ষুধা মেটানোর যন্ত্রবাদে আর কিছুই না। আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে... 

আমি আর কিছু না বলে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসলাম। আমার একহাতে খাবারের প্যাকেট আরেক হাতে বেলিফুল যাচ্ছি আর ভাবছি, জীবনের একটা সময় আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু যখন উপলব্ধি করতে পারি তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যায়....

আমার বন্ধু ইফতির সাথে দেখা হয়না অনেক দিন। হঠাৎ আজ তার সাথে দেখা, আমাকে দেখে সে হাসি মুখে জড়িয়ে ধরে কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই সে কান্না শুরু করে। আমি জিজ্ঞাসা করি,

- কি হয়েছে তোর! কাদছিস কেন? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

ইফতি বলা শুরু করল,

- মনে আছে কালেজ-ভার্সিটিতে তুই আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড ছিলি? সেই বেষ্ট ফ্রেন্ড নাফিজ এর কথা না মানার কারনে আমার আজ এই অবস্থা।

আমি তার কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে চাইলাম। ইফতি সব খুলে বলা শুরু করল,

- আমি হঠাৎ করে খারাপ সঙ্গের কারনে নেশাগ্রস্থ হয়ে পরি। সাধারন নেশাখোরদের থেকেও বেশি নেশাগ্রস্থ হয়ে যাই আমি। কিন্তু তুই আমাকে অনেক বারন করেছিলি, অনেক চেষ্টা করেছিলি এসব থেকে আমাকে বের করতে। শেষে কোন পথ না দেখে আমার বাসায় সবাইকে আমার ব্যাপারে সব কিছু বলেছিলি যাতে তারা আমার এই খারাপ অভ্যাস দুর করার জন্য যাকে কিছু করে।

আমি বললাম, - ত আমিকি খারাপ করেছিলাম নাকি? তাতে সমস্যা কি হয়েছে?

সে আবার বলা শুরু করল,

- এলাকায় জানাজানি হয়ে যায় তাই বাসা ছাড়তে হয়। তারপর আমার পরিবার আমাকে রিহাব সেন্টারে পাঠায়। অনেক কষ্ট হয় অনেক সময় লাগে ঠিক হতে। কিন্তু এখন আমি বুঝতেছি আমি কত বড় ভুল করেছিলাম। যে ভুলের মাসুল এখনও দিতে হচ্ছে আমাকে।

আমি, - তুই নেশা করা ছেড়ে দিয়েছিস! আলহামদুলিল্লাহ। তা সমস্যা কি হয়েছে আবার?

ইফতি বলল,

- আমার রেজাল্ট ভালো হয় নি, অনেক টাকা খরচ হয়ে যার রিহাব সেন্টারে আমার জন্য, আত্মীয় স্বজনদের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে যাই, ভালো চাকরি পাই নাই। শুধু এই না অতিরিক্ত নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের কারনে আমার বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। 

এই বলে সে আমার কান্না শুরু করে। তার কথা শুনার সময় আমার চোখে পানি চলে আশে। আতি তাকে বলি,

- আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। তুই যখন বুঝতে পেরেছিস তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, যদি সেই সময় বুঝতি তাহলে আজ এত কিছু হত না। থাক অতীত থেকে বের হয়ে আয় আর বর্তমান নিয়ে চিন্তা কর। আমি ইনশাহআল্লাহ কিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।

ইফতি জানতে চাইল আমি কি করতে পারব। তখন আমি বললাম,

- আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করি সেখানে আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো অবস্থানে আছি। সেই খানে কর্মঠ কিছু মানুষের দরকার তারপর চ্যালারিও ভালো দিবে। কন্ডিসন অনার্স পাস, এছাড়া তুই এত খারাপ নাম্বারও পাসনি তোর চাকরি হয়ে যাবে ইনশাহআল্লাহ।

আনন্দে তার চেহারা পাল্টে যায়। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে আমাকে কোলে নিয়ে নাছা শুরু করে। তখন আমি মুসকি হেসে চিন্তা করছিলাম উপলব্ধি করতে দেরি হলে মানুষকে জীবনে কত খারাপ পরিস্থিতির শিকারই না হতে হয়!

ফেরাউনকে সবসময় মুসা (আ) দাওয়াত দেওয়ার পরেও সে এক আল্লাহর প্রতি ইমান আনেনি। কিন্তু যখন সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছিল তখন সে ইমান আনে ও ক্ষমা চাচ্ছিল। যখন সে ইমান এনেছিল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই তার ক্ষমা আল্লাহ কবুল করেন নি। লূত (আ), নূহ (আ) এর কউম কি খারাপই না ছিল। এত বুঝানোর পরেও তারা বুঝতে চেষ্টা করে নি। কিন্তু যখন উপলব্ধি করতে পেরেছিল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। কারন তখন তাদের উপর আল্লাহর আজাব শুরু হয়ে গিয়েছিল। 

তাই বলি অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন আপনি যা করছেন বা করবেন তা কি আসলেই ঠিক হচ্ছে কিনা বা ঠিক হবে কিনা। অনেক দেরি যাতে না হয়ে যায় উপলব্ধি করতে। এমন অনেক কাজ আমরা করছি যা ভালো হচ্ছে কিনা চিন্তাও করছি না। যেমন - মুসলিম-মুসলিম সত্রুতা, আলেমে আলেমে কামরা কামরি, গুনার কাজে মগ্ন থাকা, জ্ঞানের বাহিরে কথাবার্তা বলা, আল্লাহর সন্তুষ্টি আর্জনের কোন কাজ না করা ইত্যাদি। যেদিন উপলব্ধি করতে পারবেন হয়ত সেদিন আপনার হাতে আর সময় থাকবে না হয়ত তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।

Ashraful Nafiz

I am an ordinary Muslim student who is interested in acquiring the beneficial knowledge given by Allah and hopes to spread that knowledge among the people. facebook youtube twitter instagram quora

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Would you tell me something

নবীনতর পূর্বতন