শুধু কুরআন বিশ্বাসকারীদের (আহলে কুরআন) সম্পূর্ণ ভুল সংশোধন [পার্ট ২]

আমার অনেক ভাইয়েরা বলে থাকেন যে, হাদিসের কিতাব গুলোতে যে হাদিস গুলা আছে সেগুলার সত্যতা কি? এসব হাদিসকে কেন সত্য মনে করে মানব? এগুলাত অনেক পড়ে সংকলিত হয়েছে তাই এসব মিথ্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তর দেওয়ার আগে একটা কথা বলি সেটা হল ‘হাদিস সংকলেন ইতিহাস’ নিয়ে বাংলায় লিখা বা অনুবাদ করা বহু বই রয়েছে সেই বইগুলো পড়তে পারেন, অনেক কিছু জানতে পারবেন।

Table of Contents

{tocify} $title={Table of Contents}

হাদিস মানা-না মানা নিয়ে কিছু কথা

সোজা একটা কথা কোরআন শরীফে থাকা ইসলামি বিধি-বিধানের বিশ্লেষণ এবং তা বাস্তবায়নের কার্যকর পন্থার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে হাদিসে। ইসলামের মুল বই হলো কোরআন, আর গাইড বই হলো হাদিস। গাইড বইতে মুল বইয়ের অনুশীলন, ব্যাখ্যা ইত্যাদি থাকে। সহজ ভাষাতে বললে, হাদিস হল কোরআনের এক ধরনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা। আর রাসুল এর চেয়ে ভালো কোরআনের ব্যাখ্যা আর কে করবে?

অহি প্রধানত দুই প্রকার। একটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ অহি। এই অহি হজরত রাসূলুল্লাহ এর ওপর সরাসরি নাজিল হতো। অন্যটি হচ্ছে পরোক্ষ অহি। এই অহি হজরত রাসূলুল্লাহ এর ওপর প্রচ্ছন্নভাবে নাজিল হতো। ইসলামি পরিভাষায় হাদিস ও সুন্নাহ হলো ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ এর বাণী, কার্যক্রম, মৌন সম্মতি, সমর্থিত রীতিনীতি, জীবনাচরণ ইত্যাদি। তবে মুহাদ্দিসগণ রাসূলুল্লাহ সম্পর্কিত বর্ণনা ও তার গুণাবলি সম্পর্কিত বিবরণকে ও সাহাবিদের আমলকেও হাদিসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এখন বুখারিতে ৭ হাজার এর বেশি হাদিস আছে এর মধ্যে পুনরুল্লেখ ছাড়া হয়ত ৫ হাজারের কাছাকাছি হাদিস রয়েছে, সহিহ মুসলিমেও ৭ হাজার এর বেশি হাদিস আছে এর মধ্যে পুনরুল্লেখ ছাড়া আনুমানিক ৪ হাজারের মত হাদিস রয়েছে। বুঝানোর জন্য এই কিতাবগুলার কথা বলছি।

এখন এই হাদিস গুলার বিশুদ্ধতায় আসি। এই হাদিস গুলার বর্ননার ক্রম ধারা পর্যালোচনা করে সনদে রাবীদের সবার গ্রহনযোগ্যতা, নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, সত্যবাদিতা যাচাই করে, বর্ণনাকারীদের মধ্যে কোন রাবী বাদ পরেছে কিনা সেটা যাচাই করে, সাংঘর্সিক হাদিস আছে কিনা সেটা যাচাই করে, সনদে সাহাবির নাম বাদ পরেছে কিনা সেটা দেখে, বর্ণনাকারীর স্মৃতিশক্তি পর্যালোচনা করে, হাদিসের ধরন ও হাদিসের ভাষা পর্যালোচনা করে, বর্ণনাকারীদের পরপষ্পরের মধ্যে বাস্তবে সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা সেটার প্রমান বের করে, রাবীদের পরস্পরের সাথে জন্ম, মৃত্যু সনের একটা হিসাব করে, রাবীদের হাদিস বর্ণনা করার সামর্থ্য বিবেচনা করে, হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে কে কার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছে সেটা বিবেচনা করে, একটা হাদিস কতগুলা সনদে পাওয়া যায় সেটা বিবেচনা করে এক একটা হাদিসের পিছনে ১৫/২০ জন করে বিক্ষ্যাত হাদিস বিশারদগণ মত প্রধান করেছেন। শুধু এসবই না অনেক ইমামেরত এসব ছাড়াও আলাদা কিছু শর্ত ছিল হাদিস গ্রহন করার। যেমন আবু হানিফা তাদের থেকেই হাদিস গ্রহন করতেন যারা হুবহু সনদসহ মুখস্ত বলতে পারবেন, লিখিত হলে তা গ্রহন করতেন না। এমন আরো অনেক ধরনেরই শর্ত স্কলাররা যুক্ত করেছিলেন হাদিস গ্রহন করার ক্ষেত্রে।

এটাত গেল সনদ পর্যালোচনা, হাদিস কোন ধরনের মানুষ থেকে সংগ্রহ, সংকলন ও বর্ণনা করা হত সেটা বলি। যারা হাদিস সংকলন করেছিলেন তারা কেউই যে কোন সাধারন মুসলিম থেকে হাদিস বর্ণনা বা সংগ্রহ করতেন না। মহানবীর থেকে সাহাবি, সাহাবি থেকে তাবেই, তাবেঈ থেকে তাবে তাবেঈ, তাবে তাবেঈ থেকে তাদের ছাত্র, সেই ছাত্রদের থেকে তাদের ছাত্র, সেই ছাত্রদের থেকে তাদের ছাত্র এই ক্রম যদি সঠিক হয় তাহলেই হাদিস গ্রহন করা হত, এছাড়া কিছু ব্যাতিক্রম আছে সেটা ভিন্ন বিষয়।

হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা সমূহ বেশ সমৃদ্ধ ও বিস্তর। সেখান থেকে ২/৩ প্রকারের হাদিসের কথা বলি, অবশ্যই সমস্ত হাদিস এই কয়েক প্রকারের মধ্যে পরে। রাবির সংখ্যা অনুসারে হাদিস দু’প্রকার: মুতাওয়াতির ও আহাদ বা খবরে ওয়াহেদ। সনদ সহিহ হলেও আহাদ হাদিসের তুলনায় মুতাওয়াতির হাদিস অনেক অনেক বেশি শক্তিশালি ও গ্রহনযোগ্য। কারন মুতাওয়াতির হাদিস হল যে হাদিস অনেকগুলো সাহাবি থেকে বর্ণিত হয়েছে ও সেগুলো তাদের থেকে বৃহৎ জনসংখ্যাক রাবী কতৃত পরবর্তি প্রজন্মের কাছে বর্ণিত হাদিস অর্থাৎ এসব হাদিসের সনদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের রাবীর সংখ্যা অনেক বেশি যার কারনে এগুলো মিথ্যা হওয়ার সম্ভবনা প্রায় অসম্ভব। আর আহাদ হাদিস হল যে হাদিস শুধু ২/৩ জন রাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে ও এসব হাদিস মুতাওয়াতির হাদিসের মত এত বেশি বর্ণিত হয়নি। এখানে বলে রাখা ভালো যে লোক মুখে বর্ণিত বা সাধারন আরেমদের মুখে বর্ণিত হাদিস মুতাওয়াতির হয় না বরং যে হাদিস অনেক বেশি রাবীদের দ্বারা বর্ণিত হয় শুধু সেগুলোই মুতাওয়াতির হাদিস হিসেবে গণ্য হয়। লোক মুখে বা সাধারন আলেমদের মুখে বর্ণিত হাদিস গ্রহনযোগ্য নয়। এই কারনে মুতাওয়াতির হাদিস গ্রহন করা সবার উপর বাধ্যতা মূলক।

হাদিসের বর্ণনা কারীদের একটা লিস্ট আছে, বর্ণনাকারীদেরকে সাধারনত রাবী বলা হয়। এই রাবীদেরকে নিয়ে অনেকগুলা কিতাব আছে সেগুলাকে রিজাল শাস্ত্র বলা হয়। রিজাল শাস্ত্রে রাবীদের জীবনি, তাদের বর্ণনার গ্রহনযোগ্যতা, তাদের সততা, তাদের সঠিকত্ব, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর গবেষনা ও আলোচনা করা হয়েছে। এসবের উপর ভিত্তি করেই কোন হাদিস সহিহ হবে আর কোন হাদিস সহিহ হবে না সেটা নির্ধারন করা হয়, এইসবের উপর ভিত্তি করে হাদিসের বিভিন্ন মান দেওয়া হয়ে থাকে। সাধারনত যারা মুহাদ্দিস তারা এই রিজাল শাস্ত্রের উপর আগে পান্ডিত্য অর্জন করে থাকেন, তারপরই কোন হাদিসকে সহিহ বা সহিহ না বলার যোগ্যতা অর্জন করে থাকেন। এই শাস্ত্রের উপর একবার পান্ডিত্য অর্জন করতে পারলে তার সামনে যেই হাদিসই আসুক না কেন, কিছুক্ষন হাদিসের সনদ নিয়ে চিন্তা করলে সে বলতে পারবে হাদিসটি সহিহ নাকি সহিহ না।

এ সবকিছু পর্যালোচনা করে অর্থাৎ হাদিসের গ্রহনযোগ্যতার উপর ভিত্তি করে হাদিসকে সহিহ, হাসান, যয়িফ, মুনকার, জাল ইত্যাদি স্তর ও উপস্তরে ভাগ করা হয়েছে, প্রায় ১৮ বা তারচেয়ে কিছু কম-বেশি প্রকারে স্তর উপস্তরে হাদিসকে ভাগ করা হয়েছে সেখান থেকে শুধু ৩ প্রকার হাদিসকে গ্রহন করা যাবে বলে আমরা জানি, সেগুলা হল সহিহ, হাসান এবং শুধু ছোট খাটো আমল করার ক্ষেত্রে তুলনা মূলক কম যয়িফ বা হাসান লিগাইরি এমন হাদিসকে মানা যাবে এটা সর্বস্বীকৃত।

পরস্পর বিপরীত হাদিস থাকার কারন নিয়ে কিছু বলি। যেমন [সহীহ বুখারীর ২৯২ ও ২৯৩ এবং সহিহ মুসলিম ৬৬৫ নং হাদীস] অনুযায়ি স্বামী-স্ত্রীর সহবাসে বীর্যপাত নাহলে গোসল ফরজ হবে না, কিন্তু [বুখারি, হা. ২৯১, মুসলিম, হা. ৩৪৩] অনুযায়ি গোসল ফরজ হয়ে যায় সহবাসে বীর্যপাত না হলেও। এর কারন হচ্ছে উপরে উল্লেখিত ১ম হাদিসটির আমল রহিত হয়ে গেছে কারন এটা আমাদের নবীর নবুয়তি জীবনের প্রথম দিকের আমল কিন্তু পরবর্তি আমল অনুযায়ি বীর্যপাত না হলেও গোসল ফরজ হয়ে যাবে। নবী কখনো দাঁড়িয়ে প্রসাব করেননি [হাম্বল-৬/১৩৬,১৯২,২১৩, সুনানে তিরমিযী ১২, মুজামে ইবনে আসাকীর, ৩৬৬] আবার আরেক রেওয়ায়াতে দেখা যায় নবী কোন এক গোত্রের আবর্জনার স্থানে গেলেন এবং (সেখানে) দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলেন। [বুখারী ২২৪, মুসলিম ২৭৩] এর কারন ছিল যে, মহানবী কোন ওযরের কারণে এরূপ করেছেন। এই কারনে এখন স্বাভাবিক অবস্থায় দাড়িয়ে পেশাব করা মাকরূহ। কিন্তু যদি এমন স্থানে পেশাব করতে হয়, যেখানে দাঁড়িয়ে ছাড়া করা সম্ভব নয়। যেমন দাঁড়িয়ে পেশাব করার বুথ ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা না থাকে, এমন আবর্জনাময় স্থান যে, এখানে বসে পেশাব করলে শরীরে নাপাক লেগে যাবার সম্ভাবনা থাকে ইত্যাদি উজর থাকলে উপরোক্ত সময় দাঁড়িয়ে পেশাব করা জায়েজ আছে।

আপনি হয়ত যানেন না যে বুখারি মুসলিমের সব হাদিসকে মানুষ সহিহ বললেও আসলে কিন্তু হাদিস বিশারদগণ এই কথার সাথে একমত না কারন সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের মধ্যেও কিছু হাদিস আছে যেগুলা নিয়ে হাদিস বিশারদগণ সন্দেহ পোষন করেছেন, সাধারন মানুষের পক্ষে হাদিসের তাহকিক, সেই সম্পর্কিত আরো হাদিস, হাদিসের প্রেক্ষাপট, হাদিসের বিশুদ্ধতা ইত্যাদি সম্পর্কে পড়া সম্ভব হয়ে উঠে না তাই বেশির ভাগ মানুষ শুধু হাদিস পড়েই ভুল বুঝে থাকে।

যখন থেকে হাদিস সঃকলন শুরু হয়েছে তখন থেকে প্রতিটা যুগে হাদিসগুলোকে বার বার ফিলটার করা হয়েছে বড় বড় ইসলামিক স্কলার দ্বারা। হাদিসের কিতাবগুলোর সব হাদিস যদি মিথ্যা হত তাহলে এত হাদিসের প্রকার কেন তৈরি করা হয়েছে তাও আবার এতগুলা প্রকারের মধ্যে বার বার ফিলটার করে শুধু ৩ প্রকার হাদিসকে গ্রহন করা যাবে বলা হয়েছে এবং বাদ বাকিগুলা সঠিক হতে পারে তা বিশ্বাস করাত দূরের কথা আমলও করা যাবে না। এত ফিলটার করার পরও যদি বলেন সবমিথ্যা তাহলেত ভাই আপনাদেরকে কিছু বলার নেই কারন বুঝাই যাচ্ছে যে আপনারা নিজের সার্থ হাসিলের জন্য হাদিস মানছেন না। আর আল্লাহ বলেছেন, 

  • “আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে সত্য গোপন করো না” (সূরা বাকারা আয়াত ৪২)

আল্লাহ কোরআনে অনেক যায়গায় বলেছেন মহানবী (সা) নিজের মত করে কিছু বলেন না, মাহাম্মদ (সা) এর কাছে কোরআন ছাড়াও অহি আসত, মহানবী (সা) যে বলেন সেটাই আল্লাহর আদেশ, আমাদের নবী (সা) এর আদেশ মানতে হবে ইত্যাদি  শুধু কুরআন বিশ্বাসকারীদের (আহলে কুরআন) ভুল সংশোধন [পার্ট ১]

অনেকে বলে সব হাদিস মিথ্যা এই কথাটাই কেমন জানি হাস্যকর ও রূপকথার মত মনে হয়। কারন সব হাদিস মিথ্যা হওয়ার সম্ভবনাটা অনেক অনেক অনেক কম। আমি কিছু মানুষকে দেখেছি তারা হাদিস মানতে চায় না কিন্তু তাফসির মানে, আজবত!! তারা যখন জানে যে তাফসির মানুষের লিখা তাহলে তারা সেটা মানতে পারে কিন্তু হাদিস মানতে পারেনা যেখানে অনেক গুলা হাদিস কোরআনের আয়াতের তাফসির সরূপ ও গ্রহনযোগ্য হাদিসগুলাযে আসলেই নবীর থেকে প্রাপ্ত তার সম্ভবনাটা অনেক অনেক অনেক বেশি।

আবার যদি হাদিস মানতে অস্বীকার করেন তাহলে মহানবীর সিরাত ও শানে নুজুলও অস্বীকার করার কথা, তাই না? কোরআনে এমন অনেক আয়াত আছে যেগুলাকে নবীর সীরাত ও শানে নুজুল ছাড়া পড়লে যেকোন মানুষ ভুল বুঝতে পারে। এখানেও সেগুলা মানার জন্য অনেক বড় কারন বেরিয়ে এল।

এছাড়া ইসলামের বিধানগুলার ক্ষেত্রে যেগুলা কোরআনেও আছে যেমন বিবাহ, তালাক দেওয়া, সালাত, হজ, যাকাত, কোরবানি, আইন প্রয়োগ, দুধসম্পর্কিত মাহরামের বিভিন্ন বিষয়, হদ কায়েম, শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা, রহিত হওয়া আয়াত ইত্যাদি সেগুলার ক্ষেত্রে হাদিস না মানলে আমাদের সেই বিধানগুলা সঠিক পদ্ধতিতে মানতে অনেক বেশি সমস্যার সম্মুক্ষিন হতে হবে বা হয় কিন্তু হাদিস মানলে সেই সব সমস্যা আর হয় না। এছাড়া হাদিস না মানলে আমরা কখনোই বলতে পারব না ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।

এছাড়া হাদিসে এমন অনেক ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে যা বর্তমানে সত্য হয়েছে বা হচ্ছে, হাদিসে বর্ণিত মহানবী (সা) এর অনেক বাণীর সত্যতার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিজ্ঞান এর মাধ্যমে, হাদিসে এমন অনেক ঘটনা উল্লেখ আছে যেগুলার প্রমান মানুষ অন্য কোননা কোনভাবে পেয়েছে, এমন অনেক হাদিস আছে যেখানে আমরা দেখি আমাদের নবী কারো জন্য দোয়া করছেন এবং তার দোয়া এখনো সেই মানুষগুলা ভোগ করছে। এখন যারা পায়ের উপর পা তুলে হাদিসকে অস্বীকার করছে ও শুধু কোরআন মানতে বলছে তাদের সম্পর্কেও আমাদের নবী অনেক আগেই ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে এমন মানুষেরও আবির্ভাব হবে এবং এই ধরনের মানুষকে সতর্ক করেছেন ও আমাদেরকেও সতর্ক করেছেন এই ধরনের মানুষ হতে।  (তিরমিজী ২৬৬৩, ২৬৬৪, আবূ দাঊদ ৪৬০৪, ৪৬০৫, দারিমী ৫৮৬, ইবনে মাজাহ ১২, ১৩)

আপনাদের কাছে কোন প্রমান নেই যে হাদিস বিশারদগণ যেগুলাকে সহিহ বলেছেন সেই হাদিসগুলা মিথ্যা বরং আপনারা সম্পূর্ণ ধারনার উপর হাদিসগুলাকে মিথ্যা বলছেন, আর সবহাদিসকে এক চেটিয়া মিথ্যা বলার পক্ষে শক্তিশালী কোন প্রমান আছে বলে মনে হয় না আমার। আর কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, 

  • “হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ।” [সুরা হুজরাত : আয়াত ১২] 

হাদিস মানার জন্য অন্তত উপরে যেগুলা লিখেছি তাই ইনশাআল্লাহ যথেষ্ট তারপরেও যদি হাদিস না মানতে চান তাহলে কিছুই করার নেই কারন বুঝাই যাচ্ছে যে আপনারা নিজের সার্থ হাসিলের জন্য হাদিস মানছেন না। 

মাত্র ১৫ বছর আগে, স্মার্ট-ফোন জিনিসটা বাজারে এসেছে। স্মার্ট-ফোন এর এপস (সফটওয়্যার) আকারে বিভিন্ন বই পত্র পাওয়া যায়। আপনি রবীন্দ্রনাথের বই পেতে পারেন। এর আগে, সিডিতে বই পাওয়া যেতো। রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১ সালে মারা গেছেন। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৬০-৭০ বছর, পরে এই বই এর সিডি ও এপস বানানো হয়েছে। এই কারনে আপনি কি এই প্রশ্ন করেন, সিডি ও মোবাইল এপসে রবীন্দ্রনাথের লেখা কতখানি সঠিক?

আপনি এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন না, কারন আপনি জানেন, কম্পিউটার ও স্মার্ট-ফোন আসার অনেক আগে, রবীন্দ্রনাথ বেচে থাকতেই তার লেখা বই আকারে ছিল। সেই বই দেখেই সিডি ও এপস বানিয়েছেন। অর্থাৎ, বই আর সিডিতে একই জিনিস আছে। আপনি এটাও জানেনে - রবীন্দ্রনাথের মুল বইতেও সামান্য কিছু ভুল আছে। মানুষের পক্ষে ১০০% নির্ভুল বই বানানো সম্ভব নয়। 

রবীন্দ্রনাথের ঘটনার পরে, এবার আপনার নানীর কথা বলছি। আপনার নানী অবশ্যই খুব ভালো রান্না করতেন। তিনি রান্না শিখেছিলেন তার মায়ের কাছ থেকে। তিনি আবার শিখেছিলেন, তার মায়ের কাছ থেকে। এভাবে ৭-৮ প্রজন্ম ধরে একই রান্না শিখে আসছে। প্রথম প্রজন্মের নারী হয়তো ৪০০ বছর আগে বেচে ছিলেন। ধরে নিলাম, প্রথম সেই নারীর নাম ছিলো "জামিলা বেগম"। সেই জামিলা বেগমের মেয়ে, তার মেয়ে, তার মেয়ে, এভাবে সবাই জামিলা বেগমের রান্না শিখেছে। এভাবে বংশ পরম্পরায় আপনার মা রান্না শিখেছেন। তিনিও নিজের মেয়েকে শিখিয়েছেন। এতগুলো প্রজন্মের সবাই, জামিলা বেগমের সেই রান্নার প্রনালী শিখে রাখলেও, লিখে রাখেনি। আপনি আধুনিক যুগের মানুষ। আপনি চিন্তা করলেন, লিখে রাখলে ভালো হবে। সেজন্য আপনি একটি বই লিখলেন - জামিলা বেগমের রেসিপি।

এখানে যেটা বোঝার আছে, সেটা হলো, জামিলা বেগমের মৃত্যুর ৩০০ বছর পরেও তার রান্নার রেসিপি নিয়ে বই লেখা গেছে, কারন প্রত্যেক প্রজন্মে তার রান্নার চর্চা হয়েছে। এই রান্নার বইতে অবশ্যই ভুল আছে। জামিলা বেগম বেচে থাকার সময় বইটি লিখতে পারলে, ভুল কম হতো। তবে, কোনভাবেই এই বইটি ১০০% নির্ভুল বানানো যেতো না। 

লেখার প্রথমে সুন্নাহ এর কথা বলেছি। সুন্নাহ হল, রাসুল এর শেখানো নিয়ম-কানুন। শত বছর ধরে, বংশ পরম্পরায়, মানুষ এই নিয়ম শিখেছে, পালন করেছে। এমনই এক পর্যায়ে, কিছু মানুষ এই "নিয়ম-কানুন" বই আকারে লেখার চিন্তা করলো। সেই বইকে আমরা হাদিস বলে চিনি। অবশ্যই এই বইতে (হাদিসে) ভুল আছে। রাসুল (সা) এর আমলে এই বই লিখলে কম ভুল হতো। তবে কোনভাবেই বইটিকে ১০০% নির্ভুল বানানো যেতো না

  • ভুল বুঝবেন না - হাদিসের ভুল মানে, বই লেখাতে ভুল। রাসুল (সা) অবশ্যই সঠিক নিয়ম-কানুন বানিয়েছেন। তবে, বিভিন্ন মানুষ নিজের অজান্তে বইতে ভুল তথ্য লিখেছে।

পরিশেষে বোঝা গেলো, অনেক পরে লেখা হয়েছে বলে হাদিস অসুদ্ধ হয়ে যায়নি। তবে এর ভেতরে সামান্য কিছু ভুল তথ্য থাকলেও থাকতে পারে। সঠিক হাদিস বাছাই করার জন্য ইসলামিক গবেষক আছে। এভাবে অনেকটাই রক্ষা হয় ঠিকই। তবে সম্পূর্ণ ১০০% নির্ভুল হয় নাও হতে পারে। পাশ্ব প্রতিক্রিয়া মেনে নিয়েই রোগমুক্তির জন্য ওষুধ খেতে হয়। আর কোন উপায় নেই। ঠিক তেমনি, সামান্য কিছু ভুল তথ্য থাকলে, সেটা জেনেও হাদিস অনুসরন ছাড়া, আর কোন উপায় নেই।

কিন্তু যারা একচেটিয়া হাদিসকে ভুল, মিথ্যা বলে অস্বীকার করে তাদের হাদিস সম্পর্কে ভালো জ্ঞান আছে কিনা সন্দেহ, হাদিসের সনদ সম্পর্কে তাদের বিন্দু মাত্র জ্ঞান আছে কিনা সন্দেহ, হাদিসের পরিভাষাগুলো সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান আছে কিনা সন্দেহ। হাদিসের সনদ, হাদিসের উৎস, হাদিসের রাবি, হাদিসের তাহকিক, হাদিসের সত্যতা, হাদিসের মান, হাদিসের পরিমান, হাদিসের ইতিহাস, হাদিসের সংকলন, হাদিস প্রয়োগের সঠিক প্রক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের মত মানুষদের বিন্দু মাত্র জ্ঞান নেই। 

তারা হাদিস অস্বীকার করার জন্য অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কিছু এমন হাদিস যেগুলা গ্রহন যোগ্য নয়। যেমন সেটানিক ভার্সের সেই ঘটনা, মহানবীর সমকামিতা নিয়ে কিছু হাদিস, কিছু মানুষকে সামান্য বিষয় নিয়ে হত্যা করার ঘটনা, বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত কিছু কথার সরাসরি বিরোধী কিছু হাদিস ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলো যে আসলে যয়িফ মানে দূর্বল অর্থাৎ অগ্রহনযোগ্য সেটা কি যানে তারা!? তাদেরত হাদিসের সনদ ও উল্লেখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে কোন জ্ঞানই নেই তাহলে জানবেন কিভাবে! জীবনে কখনো সিরাত গ্রন্থগুলো পড়ে দেখে? যেমন তাবাকাত, তাবারি, হিসাম ইত্যাদি ব্যাক্তিদের? সেগুলোর টিকায় লিখাও থাকে কোন বর্ণনা সহিহ ও কোন বর্ণনা সহিহ না। 

কিন্তু তারা কিভাবে জানবে এসব! এসব জানতে পড়তে হয়, শিক্ষা গ্রহন করতে হয়। কিন্তু তাদেরত ইসলামিক তেমন শিক্ষাও নেই জ্ঞানও নেই, আছে শুধু গলার জোর। যখন হাদিস সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকে না তখন তাদের মতই মূর্খতা করা যায়। সীমিত জ্ঞান নিয়ে আহলে কোরআনগণ মূর্খতার সব সিমানা পার করেই যাচ্ছেত করেই যাচ্ছে, যার শেষ সিমানা জাহান্নাম।

হাদিস সংকলন বিষয়ে কিছু কথা

সাহাবায়ে কেরাম (রা) নবী করিম এর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তার প্রতিটি কাজ ও আচরণ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতেন। হজরত রাসূলুল্লাহ সাহাবিদেরকে ইসলামের আদর্শ ও এর যাবতীয় নির্দেশ যেমন মেনে চলার হুকুম দিতেন, তেমনি তা স্মরণ রাখতে এবং অনাগত মানব জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

হজরত রাসূলুল্লাহ এর বাণীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সাহাবিরা হাদিস সংরক্ষণে উদ্যোগী হন। প্রধানত তিনটি শক্তিশালী উপায়ে নবী করিম এর হাদিস সংরক্ষিত হয়। ১. উম্মতের নিয়মিত আমল, ২. হজরত রাসূলুল্লাহ এর লিখিত ফরমান, সাহাবিদের কাছে লিখিত আকারে সংরক্ষিত হাদিস ও পুস্তিকা এবং ৩. হাদিস মুখস্থ করে স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত রাখা, তারঃপর বর্ণনা ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে লোক পরম্পরায় তার প্রচার।

আমরা কমবেশি সবাই জানি বুখারি ৬ লক্ষ হাদিস সংগ্রহ করেছিলেন ও সেখান থেকে ৭ হাজারের মত সহিহ বুখারীতে লিপিবদ্ধ করেছেন, ইমাম মুসলিমও নিজের কিতাব সহিহ মুসলিমে ৩ লক্ষ হাদিস থেকে বিচার বিবেচনা করে ৭ হাজার হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে বাদবাকিগুলা কি ভুল হাদিস ছিল? আসলে ইমাম বুখারি ও মুসলিম শুধু সহিহ হাদিস নিজের কিতাবে রাখতে চেয়েছিলেন তাই অনেক হাদিস যেমন হাসান, হাসান সহিহ, যয়িফ, মওযু, মুরসাল, মুনকার হাদিস ইত্যাদি তারা বাদ দিয়েছিলেন। আবার অনেক হাদিস দেখা যায় সহিহ কিন্তু হুবহু বেশ কয়েকজন থেকে বর্ণনা করা হয়েছে তাই তারা সেগুলা থেকে শুৃধু কয়েকটা পুনরুল্লেখ করেছেন বাদ বাকি গুলোকে নিজের কিতাবে রাখেন নি। যেমন শুধু নিয়্যাত সম্পর্কিত হাদিসটির প্রায় ৭০০ শতর মত সনদ রয়েছে [তাদবীন  পৃষ্ঠা ৫৪]। অর্থাৎ একই বর্ণনা, একই হাদিস কিন্তু বর্ণনা করেছেন প্রায় ৭০০ জনের মত, আমাদের মুহাদ্দিসগণ হাদিসের যতটি সনদ রয়েছে সেটিকে তত সংখ্যক হাদীস বলে গণ্য করতেন, মুহাদ্দিসরা সনদের উপর ভিত্তি করে হাদিসকে কাউন্ট করতেন, মতনের উপর ভিত্তি করে নয়, এসবের উপর ভিত্তি করেই ৩ লক্ষ বা ৬ লক্ষ হাদিসের কথাটা বলা হয়ে থাকে।। একই ধরনের ঘটনা ইমাম মুসলিম (রহ), ইমাম আবু হানিফা (রহ), ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ), ইমাম তিরমিযী (রহ) এর সাথেও ঘটেছে এবং ওনারা অসংখ্যা জাল ও বানোয়াট হাদিস পেয়েছিলেন এবং তারা সেগুলাকে প্রত্যাক্ষ্যানও করেছেন আবার কিছু নিজেদের কিতাবে স্থানও দিয়েছেন।

হিজরি দ্বিতীয় শতকের শুরু থকে কনিষ্ঠ তাবিঈ ও তাবিঈ-তাবিঈনের এক বিরাট দল সাহাবা ও প্রবীণ তাবিঈনের বর্ণিত ও লিখিত হাদিসগুলো ব্যাপকভাবে একত্র করতে থাকেন। এ সময় খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ) দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকদের নিকট হাদিস সংগ্রহ করার জন্য রাজকীয় ফরমান প্রেরণ করেন। ফলে সরকারি উদ্যোগ সংগৃহীত হাদিসের বিভিন্ন সংকলন সিরিয়ার রাজধানী দামেশক পৌঁছতে থাকে। খলিফা সেগুলোর একাধিক পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দেশের সর্বত্র পাঠিয়ে দেন।  

হিজরি দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধ থেকে চতুর্থ শতকের শেষ পর্যন্ত হাদিসের চর্চা আরও ব্যাপকতর হয়। এ সময়কালে বোখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজার মতো সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ছয়খানি হাদিস গ্রন্থ (সিহাহ সিত্তাহ) সংকলিত হয়। এ যুগেই ইমাম শাফিঈ (রহ) তার কিতাবুল উম্ম ও ইমাম আহমদ (রহ.) তার আল মুসনাদ গ্রন্থ সংকলন করেন, এগুলা ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ে সংকলিত হাদিসগ্রন্থ।

হিজরির চতুর্থ শতকে মুসতাদরাক হাকিম, সুনানে দারে কুতনি, সহিহ ইবনে হিব্বান, সহিহ ইবন খুযায়মা, তাবারানির আল-মুজাম, মুসান্নাফুত তাহাবি এবং আরও কতিপয় হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়।  ইমাম বায়হাকির সুনানে কুবরা ৫ম হিজরি শতকে সংকলিত হয়। চতুর্থ শতকের পর থেকে এ পর্যন্ত সংকলিত হাদিসের মৌলিক গ্রন্থগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের সংকলন ও হাদিসের ভাষ্য গ্রন্থ এবং এই শাস্ত্রের শাখা-প্রশাখার ওপর ব্যাপক গবেষণা ও বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয়। হাদিসকে কিভাবে হাদিস বিশারদগণ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছে সেটা আগেই আলোচনা করেছিলাম তাই আর বলছি না।

তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঐ সকল গ্রন্থ যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিসের আগের বা পরের যুগে সংকলিত হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে বিশুদ্ধ, দুর্বল, মিথ্যা, ভুল সব ধরনের হাদীসই রয়েছে, যার ফলে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিস ভিন্ন এসকল গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। এ সকল গ্রন্থ মুহাদ্দিসদের মধ্যে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করে নি। এ পর্যায়ে রয়েছে : মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবন হুমাইদ, মুসনাদে তায়ালিসী, ইমাম বাইহাকীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থসমূহ (সুনানে কুবরা, দালাইলুন নুবুওয়াত, শুয়াবুল ঈমান,... ইত্যাদি), ইমাম তাহাবীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থসমূহ (শার্হ মায়ানীল আসার, শার্হ মুশকিলিল আসার,... ইত্যাদি), তাবারানীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ (আল-মু’জামুল কবীর, আল-মু’জামুল আওসাত, আল-মু’জামুস সাগীর,... ইত্যাদি)। এ সকল গ্রন্থের সংকলকগণের উদ্দেশ্য ছিল যা পেয়েছেন তাই সংকলন করা। তাঁরা নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের দিকে মন দেন নি। 

চতুর্থ পর্যায়ের গ্রন্থগুলো হলো এধরনের হাদীসের সংকলন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ইবন হিববানের আদ-দুয়াফা, ইবন আদীর আল-কামিল, খতীব বাগদাদী, আবু নুয়াইম আল-আসফাহানী, ইবন আসাকের, ইবনুন নাজ্জার ও দাইলামী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থসমূহ। খাওয়ারিজমী কর্তৃক সংকলিত মুসনাদ ইমাম আবু হানীফাও প্রায় এ পর্যায়ে পড়ে। এ পর্যায়ের গ্রন্থসমূহের হাদীস হয় দুর্বল অথবা বানোয়াট।

পঞ্চম পর্যায়ের গ্রন্থসমূহে ঐসকল হাদীস রয়েছে যা ফকীহগণ, সূফীগণ বা ঐতিহাসিকগণের মধ্যে প্রচলিত ও তাঁদের লেখা বইয়ে পাওয়া যায়। যে সকল হাদীসের কোনো অস্তিত্ব পূর্বের চার পর্যায়ের গন্থে পাওয়া যায় না। এসব হাদীসের মধ্যে এমন হাদীসও রয়েছে যা কোনো ধর্মচ্যুত ভাষাজ্ঞানী পন্ডিত পাপাচারী মানুষ তৈরি করেছেন। তিনি তার বানোয়াট হাদীসের জন্য এমন সনদ তৈরি করেছেন যার ত্রুটি ধরা দুঃসাধ্য, আর তার বানোয়াট হাদীসের ভাষাও এরূপ সুন্দর যে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা বলে সহজেই বিশ্বাস হবে। এ সকল বানোয়াট হাদীস ইসলামের মধ্যে সুদূর প্রসারী বিপদ ও ফিতনা সৃষ্টি করেছে। তবে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ হাদীসের ভাষা ও সূত্রের (সনদের) তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তার ত্রুটি খুঁজে বের করতে সক্ষম হন।

আমার অনেক ভাইয়েরা বলে থাকে যে হাদিস মহানবী এর মৃত্যুর ২০০ বছর পর লিপিবদ্ধ শুরু করা হয়েছে অথচ তাদের এই দাবি মিথ্যা। কিছু হাদিসে দেখা যায় যেখানে মহানবী সাহাবিদেরকে হাদিস লিখতে নিষেধ করেছিলেন [সহীহ মুসলিম ৩০০৪,  হাম্বল-৩/১২, ২১, ৩৯] কিন্তু পরে বিভিন্ন সময় তিনি অনুমতিও দিয়েছিলেন এবং সাহাবিদের দ্বারা হাদিস লিখে রাখার দলিল পাওয়া যায় [সুনানে দারিমী, হাদিস ৫০৩; সহীহ বুখারি, হাদিস ১১৩, ২২৭১, ১১৭০, ১৯১২; আবু দাউদ ৪০৮১, ৩৬৩৯; মুসনাদ আহমাদ, হাদিস ৬৫৫৫; হাম্বল-২/১৬২ তাবাক্বাত আল কুবরা -ইবনে সা’দ, ২/৩২২; জামে বায়ানিল ইলম ১/১৭; মুসতাদরাক হাকিম ৩/৫৭৩; উলুমুল হাদীস পৃষ্ঠা ৪৫] আবু বকর (রা) দ্বারা লিপিবদ্ধ করা কিছু হাদিস [সহিহ বুখারি ১৩৬৪, ১৩৬৬, ১৩৬৭, ১৩৬৯, ১৩৭০, ১৩৭১, ২৩২৫, ৬৪৮৫]

‘সহিফায়ে সাদিকা’ নামক হাদিস সংকলনের কিতাব যা লিখেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা)। সহিফা হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ একটি হাদীস সংকলন, যা আবু হুরায়রা (রা) এর ছাত্র হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ সংকলন করেন। তিনি ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ এর ভাই ছিলেন। ঠিক কত সালে তিনি এই হাদিস গ্রন্থ সংকলন করেন জানা না গেলেও আবু হুরায়রা (রা) এর মৃত্যুর আগে সংকলন করেন বলেই আলেমদের গবেষণা। সেই হিসেবে হাদিস গ্রন্থটি হিজরী ৫৮ সালের আগেই সংকলিত। এছাড়া আরেক সাহাবি আবু মুসা আল আ-আশআরী (রা) হতেও একটি সহিফা পাওয়া যায় যার নাম হল ‘সহীফা আবু মূসা আল আশ‘আরী’। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) হতেও ‘সহীফা জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ’ নামে একটি হাদিস সংকলনের কিতাব পাওয়া যায়। এছাড়া সাহাবিদের থেকে আরো কিছু হাদিসের সংকলন পাওয়া যায় সেগুলো হল, ‘কিতাব সাদ ইবনে উবাদা’, ‘সহীফা আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আওফা’, ‘সহীফা আবু সালামা আল আশজাঈ’, ‘কিতাবুচ্ছাকাহ’, ‘সহীফায়ে আমর ইবনু হাযম’, ‘সহীফায়ে আ’লী’, ‘সহীফায়ে ওয়ায়েল ইবনু হুজর’, ‘সহীফায়ে সামুরা ইবনু জুনদাব’, ‘সহীফায়ে আনাস ইবনু মালেক’, ‘সহীফায়ে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস’, ‘সহীফায়ে উমর ইবনুল খাত্তাব’, ‘সহীফায়ে উসমান’, ‘সহীফা আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ’, ‘মুসনাদু আবু হুরায়রা’, ‘রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা’, ‘মাকতুবাতে হযরত নাফে’,  ‘সহীফায়ে বশীর ইবনু নাহীক’ ইত্যাদি। [বিভিন্ন হাদিস সংকলন বিষয়ে কিতাবসমূহ হতে]

হাদিস গ্রন্থসমূহের মধ্যে ইমাম মালিকের (৭১১–৭৯৫ খ্রি.) “মুয়াত্তা” সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান প্রামান্য হাদীসগ্রন্থ। তিনি প্রায় একলক্ষ হাদীস থেকে যাচাইবাছাই করে প্রায় একহাজার নয়শ হাদীস সংকলন করেছেন। ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” গ্রন্থটি হাদীস সংকলনের ব্যাপারে বিপুল-উৎসাহ উদ্দিপনার সৃষ্টি করেছিল। এটি হাদীসশাস্ত্র অধ্যায়নে মুসলিম মণিষীদের প্রধান আর্কষণে পরিণত হয়েছিল। এর পূর্বে ইমাম আবু হানীফা (৬৯৯-৭৬৭ খ্রি.) দেশ-দেশান্তরে সফর করে বিপুল পরিমাণ হাদীস সংগ্রহ করেছেন তার সংখ্যাই হলো ৪০ হাজার। এই ৪০ হাজার থেকে সহীহ ও আমলযোগ্য আহকামের হাদীসগুলো বাছাই করে তিনি একটি হাদীসের কিতাব লিখেন, যার নাম কিতাবুল আছার। এ বিষয়ে সদরুল আইম্মা মুয়াফফাক বিন আহমদ ‘মানাকিবুল ইমামিল আযম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ৪০ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে কিতাবুল আছার লিখেছেন।

এছাড়া আল জামে সুফিয়ান সওরী, মুসনাদে উবাইদুল্লাহ ইবনে মুসা, মুসনাদুল হুমাইদী, মুসনাদে মুসাদ্দাদ ইবনে মাসারহাদ, মুসনাদ আবূ দায়ূদ তায়ালিসী ইত্যাদি হাদিসগ্রন্থ এগুলো ইমাম বুখারির অনেক অনেক আগে লিখা হয়েছে। এগুলো প্রায় ১০০ থেকে ২০০ হিজরির মধ্যে লিখা হয়েছে।

ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন কেন্দ্রে হাদীস সংকলন ও গ্রন্থ প্রণয়ন ও ফিকহি বিষয়ে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে নিম্নোক্ত মনীষিগণ উল্লেখযোগ্যঃ মক্কা শরীফে ইবনে জুরইজ (১৫০ হিঃ); মদীনায় ইবনে ইসহাক (১৫১ হিঃ) ও ইমাম মালিক (১৭৯ হিঃ); বসরায় রুবাই ইবনে সুবাইহ (১৬০ হিঃ), সায়ীদ ইবনে আবূ আরুবা (১৫৬ হিঃ) ও হাম্মাদ ইবনে সালমা (১৭৬ হিঃ); কূফায় সুফিয়ান আস-সওরী (১৬১ হিঃ); সিরিয়ায় ইমাম আওযায়ী (১৫৬ হিঃ); ওয়াসত-এ হুশাইম (১৮৮ হিঃ); ইয়েমেন মা’মার (১৫৩ হিঃ); এবং খোরাসানে জরীর ইবনে আবদুল হামীদ (১৮৮ হিঃ); আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রা) (১৮১ হিঃ), বদুল্লাহ ইবনে ওহাব (মৃঃ ১৯৫ হিঃ); আবদুর রহমান ইবনুল কাসেম (মৃঃ ১৯১ হিঃ) ও আশহুব (মৃঃ ২০৪ হিঃ), ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (মৃ. ২৩৮ হিঃ), ইমাম শা’বী (মৃ. ১০৪ হিঃ), হুশাইম ইবনে বশীর ইবনে আবূ হাযেম (মৃঃ ১৮৩ হিঃ), ইমাম মকহুল ইন্তেকাল করেন ১৩৪, আর ইমাম যুহরীও এই ১২৩-২৫ হিজরী সনের মধ্যে কোন এক সময় ইন্তেকাল করেন। [হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) (পৃ. ৩৪-৪০)]

অনেকে কিছু কিছু হাদিস মানতে চায় না যেগুলা তাদের বিবেকে বাধা দেয় বিশ্বাস করতে, কারন এমন কিছু সহিহ হাদিস আছে যেগুলা সাধারনত কিছু মানুষের জন্য বিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব। যেমন সুলাইমান (আ) এর একরাতে ১০০ স্ত্রীর সাথে সহবাস, মহানবী এর প্লেট চেটে খাওয়া, ৬ বছরের মেয়েকে বিয়ে, টিকটিকি বা গিরগিটিকে হত্যা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন মানুষ যাকে ‘বিবেক বিরোধী’ বলে গণ্য করছে, অন্যজন তাকে ‘বিবেক’ বা বুদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করতে পারেন।

সর্বশেষে একটা কথাই বলতে চাই যদি মরার পরে দেখেন যে আপনারা হাদিস না মানার কারনে জাহান্নামে যাচ্ছেন তাহলে কি করবেন? কারন হাদিসেত অনেক আদেশ-নির্দেশ রয়েছে আর আপনারা যদি হাদিস না মানেন তাহলেত সেগুলারও কোন পরওয়া করবেন না। আর আমরা যদি দেখি হাদিস মানাটা আমাদের ভুল ছিল তাহলেও আমরাত বলতে পারব যে আল্লাহ বলেছেন নবীর কথা মানতে আর নবীর কথা মানতে হলে একমাত্র পথ হাদিসের কিতাবই রয়েছে এবং উপরের কারনগুলা বলতে পারব এই ক্ষেত্রে আলহামদুলিল্লাহ আমাদের বাঁচার চান্স যদি ৯২% হয় তাহলে আপনাদের বাঁচার চান্স ৮%।

পুরো আর্টিক্যালটা পড়ার পরেও যদি আপনি শুধু কোরআন মেনে চলেন ও হাদিসকে একদমই তুচ্ছ মনে করেন বা মনে করেন যে হাদিস মানতে হবে না তাহলে সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাপার কিন্তু আল্লাহকে কি জবাব দিবেন মৃত্যুর পর সেটা আগে থেকে চিন্তা করে নিয়েন।

Ashraful Nafiz

I am an ordinary Muslim student who is interested in acquiring the beneficial knowledge given by Allah and hopes to spread that knowledge among the people. facebook youtube twitter instagram quora

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Would you tell me something

নবীনতর পূর্বতন