সুলাইমান (আ) এর দাওয়াতে মাছ এবং শাদ্দাদের বেহেস্ত সংক্রান্ত গল্পগুলো কতটুকু সত্য?

আমাদের সমাজে অনেক গুলা বানোয়াট গল্পের প্রচলন রয়েছে যার মধ্যে কিছু কিছুত সরাসরি নবীদের সানে বেয়াদপি বা মিথ্যাচার সমৃদ্ধ গল্প। আল্লাহ আমাদেরকে এসব থেকে হেফাজত করুর


Table of Contents

{tocify} $title={Table of Contents}

সুলাইমান (আ) ও মাছের কাহিনি

লোকমুখে প্রসিদ্ধ, হযরত সুলাইমান (আ) একবার আল্লাহকে বললেন, হে আল্লাহ আমি সকল সৃষ্টিজীবকে খাবার খাওয়াতে চাই ১ বছর, আল্লাহ বললেন তুমি পারবে না তারপরও সুলাইমান (আ) অনুরোধ করতে লাগলেন প্রথমে ১বছর তারপর ১ মাস তারপর ১ সাপ্তাহ একপর্যায়ে আল্লাহ এক দিনের অনুমতি দিলেন। সুলাইমান (আ) জিন ও মানুষকে হুকুম করলেন, পৃথিবীতে যত প্রকার খাদ্য শস্য আছে এবং হালাল যত প্রকার প্রাণী আছে সব হাযির কর, তারা তা করল। এরপর বিশাল বিশাল ডেগ তৈরী করা হল এবং রান্না করা হল। তারপর বাতাসকে আদেশ করা হল, সে যেন খাদ্যের উপর দিয়ে সদা প্রবাহিত হতে থাকে যাতে খাবার নষ্ট না হয়। তারপর খাবারগুলো সুবিস্তৃত যমিনে রাখা হল। যে যমিনে খাবার রাখা হল তার দৈর্ঘ্য ছিল দুই মাসের পথ। খাবার প্রস্তুত শেষ হলে আল্লাহ সাগরের একটি বড় মাছকে বললেন, যাও সুলাইমানের দাওয়াত খেয়ে। তখন মাছটি সমুদ্র থেকে মাথা উঠিয়ে বললো, হে (আল্লাহর নবী) সুলাইমান, আপনি নাকি দাওয়াতের ব্যবস্থা করেছেন? তিনি বললেন, হাঁ, এইতো খাবার প্রস্তুত, তুমি শুরু কর। তখন সে খাওয়া শুরু করল এবং খেতে খেতে খাবারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পৌছে গেল। সব খাবার শেষ করে ফেলল। তারপর বলল, আমাকে আরো খাবার দিন, আমি এখনও ক্ষুদার্থ। সুলাইমান (আ) অবাক হয়ে যানতে চাইলেন তুমি কি এর থেকেও বেশি খাও? তখন সে উত্তর দিল যে আমার রব আমাকে প্রতিদিন এর থেকে অনেক বেশি খাবার ৩ বার খাওয়ান। আজ আপনার কারণে আমাকে কম খেতে হল। এ কথা শুনে সুলাইমান আ. সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন...। 
আরেক যায়গায় পাওয়া যায়, সুলাইমান আঃ একদিনের জন্য সমস্ত সৃষ্টিজীবের খানার ইন্তেজাম করার অনুমতি আল্লাহ তাআলা থেকে গ্রহণ করেন। তারপর সমস্ত সৃষ্টিজীবের জন্য তিনি প্রচুর খাবার একত্রিত করেন। কিন্তু তা একটি সামুদ্রিক মাছ এসে এক লুকমায় খেয়ে ফেলে। খাবার পর উক্ত মাছ বলে “হে আল্লাহর নবী! আমিতো ক্ষুধার্ত! তখন সুলাইমান আঃ বললেন, “তোমার প্রতিদিনকার খাবার কি এর চেয়ে বেশি?” মাছ বলে “এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি, আমি প্রতিদিন সত্তর হাজার মাছ খাই”।

উল্লেখিত হাদিসের তাহকিক -

হাদিসটি জাল কারন -  এ ঘটনাটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। তদন্তের পর  কিতাবে হাদীস, তাফসীর বা ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে আমরা পাইনি; কিছু পন্ডিত এটি সম্পর্কে বলেছেন, তবে আমরা জানি না যে তারা এটিকে ইসরাঈলিয়াত (ইহুদি ও খ্রিস্টান ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত বর্ণনার অংশ) থেকে নিয়েছিল কিনা। এই হাদিসটির কোন সনদই নেই তাই যেখানে এই হাদিস উল্লেখ আছে সেখানে এটাকি সহিহ নাকি জাল, এটার সনদ, এটা কার থেকে বর্ণনা হয়েছে, আলেমদের দ্বারা সহিহ হওয়ার স্বীকৃতির দলিল ইত্যাদি ব্যাপারেও কিছুই উল্লেখ নেই। সাধারণ কিছু কিতাবে এই ধরনের কিছু ঘটনা পাওয়া যায় পাওয়া যায় যেমন খুতুবাতে যুলফিকার, নুযহাতুল মাযালিস ওয়া মুনতাখাবুন নাফায়িস, বায়ায়েউয যুহুর ফি ওকায়েউদ দুহুর, হায়াত আল-হায়াওয়ান আল-কুবরা ইত্যাদি কিতাবাদির মাঝে গল্প আকারে রচিত হয়েছে।

 তাছাড়া এ ঘটনার মাঝে এমন কিছু বিষয় আছে যা নিজেই প্রমাণ করে যে, ঘটনাটি সত্য নয়। 

১. একজন নবী এমন উদ্ভট ও অযৌক্তিক আবদার করবেন তা হতে পারে না। এর অর্থ দাড়ায় আল্লাহর মাখলুক সম্পর্কে তার ন্যূনতম ধারণা নেই। একজন নবীর শানে এ রকম ধারণা করা সমীচীন নয়।

২. আল্লাহ নিষেধ করার পরও একজন নবী এরকম আবদার করতে থাকবেন। আর আল্লাহও তাকে এমন অযৌক্তিক বিষয়ের অনুমতি দিয়ে দিবেন তা কীভাবে হয়? 

৩. পৃথিবীর সকল প্রাণীই কি রান্না করা খাবার খায়? মাছ কি রান্না করা খাবার খায়? 

৪. ঘটনায় বলা হয়েছে, খাবার যে যমীনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তার দৈর্ঘ্য দুই মাসের পথ। মাছটি কি দুই মাসের পথ মুহূর্তেই অতিক্রম করে ফেলল? বা এত দীর্ঘ পথ জলের প্রাণী স্থলে থাকল কীভাবে? 

৫. যে মাছের পেটে এত খাবার সংকুলান হয় সে মাছটি কত বড়! 

৬.শুধু বাতাস প্রবাহিত হওয়াই কি পাক করা খাদ্য নষ্ট না হওয়ার জন্য যথেষ্ট? 

৭. সুলাইমান (আ) বাতাসের মাধ্যমে সবার কাছে খাবার পৌছালেন না কেন?

৮. খাবার গুলাকে কি একদিনে রান্না করা হয়েছিল নাকি আস্তে আস্তে? যদি আস্তে আস্তে রান্না করে তাহলে খাবার গুলা নষ্ট হয়ে যায় নি? নাকি তিনি এত বিস্তৃত এলাকায় আগে থেকে সবাইকে বিন্যাস্ত করে রেখেছিলেন ও খাবার গুলা রান্না করেছিলেন? 

এ ধরনের আরো অযৌক্তিক ও আবিশ্বাস্যকর কথা এ কিচ্ছায় রয়েছে। যা এ ঘটনা মিথ্যা হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এমন ঘটনা  বর্ণনা করা যেমন বৈধ নয় তেমনি বিশ্বাস করাও মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। (মাসিক আলকাউসার বর্ষ: ০৯, সংখ্যা: ০২, রবিউল আওয়াল-রবিউস সানী ১৪৩৪|| ফেব্রুয়ারি ২০১৩), (ইসলাম ওয়েব . নেট - ফতোয়া নং: 336904)

শাদ্দাদের কাহিনি

আমাদের সমাজে ‘শাদ্দাদের বেহেশত’ নামে বিভিন্ন ধরনের গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে।
কেউ গল্পটি এভাবে বলেন শাদ্দাদ বিশাল রাজত্ব ও ধন-সম্পদের মালিক ছিল। তার কওমের নবী তাকে দাওয়াত দিলে সে বলে, ঈমানের বদলে কী মিলবে? নবী বললেন, জান্নাত। তখন সে ইমান না এসে নিজেই জান্নাত বানাতে শুরু করে। অনেক বছর ধরে জান্নাত বানায়; তাতে বিভিন্ন ফলের গাছ লাগায়, প্রাসাদ বানায়, নহর খনন করে, হীরা, রূপা, স্বর্ণ দিয়ে সব কিছু সাজায় ইত্যাদি। এরপর সে যখন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে তার বানানো বেহেশতের দিকে রওনা হয় তখন বেহেস্তে ডুকার আগেই আল্লাহ তাকে ও তার সৈন্য-সামন্তসহ ধ্বংস করে দেন। 

কেউ বলে, তার বানানো জান্নাত দেখতে যাওয়ার পথে একটি সুন্দর হরিণ/ কালো মানুষ দেখতে পায়। হরিণটি শিকার করতে/কালো মানুষটিকে সরাতে গিয়ে সে একটু দূরে চলে যায়। পরে দেখা যায় সেই জিনিসটাই মালাকুল মাউত হাযির হয় এবং তার রূহ কবয করে। রূহ কবজ করার আগে নাকি সে মালাকুল মাউতের কাছে অনেক অনূরোধ করে যাতে নিজের বানানো জান্নাতটা অন্তত একবার দেখতে পারে কিন্তু মালাকুল মাউত রাজি হয় না এবং সে তার বানানো জান্নাত নিজেও দেখতে পারে না।

কেউ বলে, সে তার বানানো বেহেশতে প্রবেশ করার জন্য যখন এক পা দিল,তখন দ্বিতীয় পা রাখার আগেই মালাকুল মাউত তার রূহ কবয করে ফেলে, মালাকুল মাউত নাকি শুধু সাদ্দাদের রূহ কবজ করার আগে একটু দয়া হয় কিন্তু আল্লাহর আদেশ তাই ইত্যাদি ইত্যাদি।

কারো কারো মুখে এ-ও শোনা যায়, এরপর আল্লাহ তাআলা তার ঐ জান্নাত যমিনে ধ্বসিয়ে দেন; মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। বালুর মধ্যে যে অংশ চিকচিক করে, তা শাদ্দাদের বানানো বেহেশতের ধ্বংসাবশেষ।  এ ছাড়াও শাদ্দাদের বেহেশত কেন্দ্রিক আরো অনেক কথা সমাজে প্রচলিত আছে। তার বেহেশত কীভাবে বানালো, কতজন শ্রমিক লেগেছে, এর দেয়াল কিসের ছিল,ফটক কিসের ছিল, মেঝে কিসের ছিল, ইত্যাদি। 
কোন সহিহ, হাসান, যঈফ হাদিসে এই ঘটনা পাওয়া যায় না। শাদ্দাদের বেহেশত বানানোর কিসসা একেবারেই অবাস্তব ও কাল্পনিক; নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল বা কিতাব দ্বারা তা প্রমাণিত নয়। যারা এটি উল্লেখ করেছেন তারা ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে তা এনেছেন। এজন্যই ইমাম ইবনে কাসীর ও আল্লামা ইবনে খালদুনসহ আরো অনেকেই এ কিসসাকে অবাস্তব ও কাল্পনিক বলে অভিহিত করেছেন।  (ইবনু কাসীর, তাফসীর ৪/৫০৯, আবূ শাহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়্যাত, পৃ. ২৮২-২৮৬, তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৮০২-৮০৩; মুকাদ্দামাতু ইবনে খালদূন ১/১৭ বা ১/১৮; আলইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাওযূআত ফী কুতুবিত তাফসীর ২৮২-২৮৪)
Ashraful Nafiz

I am an ordinary Muslim student who is interested in acquiring the beneficial knowledge given by Allah and hopes to spread that knowledge among the people. facebook youtube twitter instagram quora

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Would you tell me something

নবীনতর পূর্বতন